Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

প্রচার ও সত্য

জার্মানির লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মহিলা অধ্যাপক বলিয়াছেন যে, ভারতে ধর্ষণের সমস্যা বিষয়ে অনেক কিছু তাঁহার কানে আসে এবং সেই কারণে তিনি ভারতীয় ছাত্রকে তাঁহার প্রতিষ্ঠানে গ্রহণ করিতে চাহেন না, কারণ সেখানে অনেক ছাত্রী রহিয়াছে, তাঁহার বিদ্যার ভার যত ডিগ্রিই হউক না কেন, বিচারবুদ্ধির ধার সম্পর্কে গভীর সংশয়ের কারণ আছে।

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৫ ০০:২৪
Share: Save:

জার্মানির লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মহিলা অধ্যাপক বলিয়াছেন যে, ভারতে ধর্ষণের সমস্যা বিষয়ে অনেক কিছু তাঁহার কানে আসে এবং সেই কারণে তিনি ভারতীয় ছাত্রকে তাঁহার প্রতিষ্ঠানে গ্রহণ করিতে চাহেন না, কারণ সেখানে অনেক ছাত্রী রহিয়াছে, তাঁহার বিদ্যার ভার যত ডিগ্রিই হউক না কেন, বিচারবুদ্ধির ধার সম্পর্কে গভীর সংশয়ের কারণ আছে। এই ভয়ঙ্কর মানসিকতা অবশ্যই ব্যক্তিগত, ইহাকে জার্মানি বা ইউরোপ বা শ্বেতাঙ্গদের ‘ভারতদর্শন’ বলিয়া তাঁহাদের উদ্দেশে পাইকারি গাল পাড়িলে তাহাও একই গোত্রের অন্যায় হইবে— কিছু ভারতীয় পুরুষ ধর্ষণ করে বলিয়া যেমন বলা চলে না যে, ভারতীয় পুরুষরা ধর্ষণপ্রবণ, তেমনই এক জন জার্মান সম্পূর্ণ অন্যায় এবং নির্বোধ ভারতবিদ্বেষ পোষণ করেন বলিয়া রায় দেওয়া চলে না যে, জার্মানরা ভারতবিদ্বেষী। তেমন রব উঠিবার আশঙ্কা অমূলক নহে। আহত ‘জাতীয়তাবাদ’ এ দেশে আজও অনায়াসে পাশ্চাত্য-বিদ্বেষে রূপান্তরিত হইতে পারে। সেই কারণেই জার্মানির শিক্ষকের অন্যায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাবধান থাকা বিধেয়। লক্ষণীয়, ভারতে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত কালক্ষেপ না করিয়া তাঁহার দেশের ওই শিক্ষককে কঠোর ভর্ৎসনা করিয়াছেন।

কিন্তু ব্যক্তিগত বলিয়া এই প্রতিক্রিয়া নগণ্য নহে। প্রথমত, একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাবান শিক্ষকের ধারণা এবং আচরণ বহু মানুষকে প্রভাবিত করিতে পারে। দ্বিতীয়ত, ধারণাটি ব্যক্তিগত হইতে পারে, কিন্তু বিরল নহে। ভারতে মেয়েরা নিরাপদ নহে, এই বিশ্বাস বহির্বিশ্বে সুপ্রচলিত। ভারতে নারীর নিরাপত্তা অবশ্যই ব্যাহত, কিন্তু এই বিষয়ে সে দুনিয়ায় ব্যতিক্রমী নহে। ঘটনা ইহাই যে, পৃথিবীর, এবং ‘উন্নত’ দুনিয়ার বহু দেশেই নারীধর্ষণের আনুপাতিক হার ভারত অপেক্ষা বেশি: রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি সমীক্ষা অনুসারে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায় শতগুণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সতেরো গুণ, লাইপজিগ-শোভিত জার্মানিতে পাঁচ গুণ! এই সমীক্ষা সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে, প্রকৃত চিত্রে তারতম্য থাকিতে পারে, কিন্তু তাহাতে চিত্রের অর্থ বদলাইবে না।

অথচ বহির্বিশ্বে, বিশেষত পশ্চিম দুনিয়ায় প্রায়শই নারীধর্ষণে বা মেয়েদের বিরুদ্ধে অন্য নানা ধরনের হিংসায় ভারতকে আলাদা করিয়া চিহ্নিত করা হয়। জাতীয়তাবাদী অভিমান বা ক্রোধ জাহির করিয়া অথবা পশ্চিম দুনিয়ার ষড়যন্ত্রী মানসিকতার মুণ্ডপাত করিয়া ধারণা এবং বাস্তবের এই দূরত্ব মুছিয়া ফেলা যাইবে না। বরং মেয়েদের নিরাপত্তা এবং সম্মান কী ভাবে বাড়ানো যায়, সেই বিষয়ে মন দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হইবে। ভারতে মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা এবং অসম্মান বিপুল, অন্য দেশে তাহা বিপুলতর বলিয়া নিশ্চিন্ত বা গর্বিত হইবার কোনও কারণ নাই। তদুপরি, এ দেশে মেয়েদের এমন অনেক অমর্যাদা ও বঞ্চনার শিকার হইতে হয়, যাহা পশ্চিম দুনিয়ায় তুলনায় অনেক কম। যথা পণ-হত্যা বা কন্যাভ্রূণনিধন। এবং ‘ধর্মীয়’ ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তিশালী রকমারি প্রচারক প্রতিনিয়ত নানা ধরনের উৎকট নারীবিদ্বেষ প্রচার করিয়া চলিয়াছেন, ইহাও ভারতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। অধুনা এই প্রচার লক্ষণীয় ভাবে বাড়িয়াছে। এই বাস্তব ভারতে মেয়েদের মানমর্যাদা বিষয়ে বহির্বিশ্বকে আশ্বস্ত করে না। ‘ইন্ডিয়া’স ডটার’রা যে ভাল নাই, তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করিয়া বা বিদেশি শিক্ষকের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পবিত্র ক্রোধ প্রকাশ করিয়া সেই নির্মম সত্যটিকে আড়াল করা যাইবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE