ঘূর্ণিঝড় ‘হুদহুদ’ অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওড়িশার উপকূলে আছড়াইয়া পড়ার পর তিন দিন কাটিয়া গিয়াছে, তাহার ধ্বংসলীলা এখনও দুর্গত মানুষদের বিপর্যস্ত করিয়া চলিয়াছে। মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়িতেছে। দুর্গতির চিত্রটিও ক্রমশ স্পষ্ট হইতেছে। পথ-ঘাট অদৃশ্য, বিদ্যুৎ, পানীয় জল, টেলিফোন পরিষেবা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ অন্তর্হিত। ১৮ লক্ষ মানুষের শহর বিশাখাপত্তনম শ্মশানের চেহারা লইয়া দাঁড়াইয়া। ঘূূর্ণিঝড় ও তাহার জলোচ্ছ্বাস এ বার কৃষির তত ক্ষতি করে নাই। কিন্তু নাগরিক জীবনের পরিকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। সময় থাকিতে লক্ষ-লক্ষ উপকূলবাসী মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরাইয়া লওয়ায় হতাহতের সংখ্যা কমানো গিয়াছে। বস্তুত, গত অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় ফাইলিন-এর আক্রমণের ধারও বহুলাংশে ঠেকানো সম্ভব হয় এই সরকারি তৎপরতার কারণে। আবহাওয়া দফতরের চেতাবনি, ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য পথ সম্পর্কে নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী এবং তাহার ভিত্তিতে গৃহীত আগাম সতর্কতামূলক ও নিবারক ব্যবস্থা প্রাণহানির সংখ্যা সীমিত রাখিতে সমর্থ হয়, ওড়িশার সুপার-সাইক্লোনের সময় যাহা পারা যায় নাই। দুই রাজ্যের সরকারেরই এই তৎপরতা প্রশংসনীয়।
কিন্তু বিপর্যয় কেবল ঝড়ঝঞ্ঝার নয়। যে লক্ষ-লক্ষ মানুষকে ত্রাণ-শিবিরে স্থানান্তরিত করা হয়, তাঁহারা কোথায় ফিরিবেন? তাঁহাদের ভাঙাচোরা কিংবা অদৃশ্য ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশু ফিরিয়া পাওয়া দরকার। চাই খাবার, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, শিশুদের জন্য দুধ, ঔষধপত্র। নিত্যপ্রয়োজনীয় এই সব সামগ্রীর সরবরাহ দ্রুত নিয়মিত করিয়া তোলা আবশ্যক। এ কাজ কেবল সেনাবাহিনী, আধা-সেনা বা বিপর্যয় মোকাবিলার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী-বাহিনীকে দিয়া হওয়ার নয়, উপরন্তু অসামরিক, সরকারি, স্বেচ্ছাসেবী ও নাগরিক উদ্যোগেরও আবশ্যকতা আছে। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু নিজে সর্ব ক্ষণ বিশাখাপত্তনমে পড়িয়া থাকিয়া এই সব কাজের সমন্বয় ও তদারকি করিতেছেন। বিশেষত যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত স্বাভাবিক করার উপর তাঁহার অগ্রাধিকার সর্বাধিক। এ জন্য তিনি কর্তব্যচ্যুতির দায়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার নির্দেশও পুলিশকে দিয়াছেন। তবে বিপর্যয়-উত্তর ত্রাণ বণ্টন ও পুনর্বাসনের কাজটি এ দেশে প্রায়শ দলতন্ত্রের কবলে পড়িয়া যায়, যাহার ফলে প্রকৃত দুর্গতের ত্রাণ অপেক্ষা অনুগত দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ডোল বিলি করার প্রবণতা মাথা চাড়া দেয়। আর সেই ছিদ্রপথে ত্রাণসামগ্রীর বিলিবন্দোবস্তে দুর্নীতির প্রবেশ ঘটে। পশ্চিমবঙ্গে ইহা নিয়মিত প্রত্যক্ষ করা যায়। অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওড়িশা এই ব্যাধি হইতে মুক্ত না হইলেও সম্ভবত তাহার প্রকোপ কম।
এ বারও অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ওড়িশা বিপর্যয় মোকাবিলায় সেই প্রস্তুতির পরিচয় দিয়াছে। ইহার সহিত যদি পশ্চিমবঙ্গের তুলনা করা যায়, তাহা হইলেই পার্থক্যটি স্পষ্ট হইয়া ওঠে। আয়লা ঘূর্ণিঝড়ে রাজ্যের উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে যে বিপুল ধ্বংস, ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটে, তাহার পিছনে থাকিয়াছে বিপর্যয় মোকাবিলায় রাজ্যের প্রস্তুতিহীনতা। সেই অপ্রস্তুত দশা এত দিনে বিন্দুমাত্র ঘুচিয়াছে, এমন লক্ষণ নাই। নেহাত ‘হুদহুদ’ এই রাজ্যকে স্পর্শ করে নাই। করিলে ১৯৫ কিলোমিটার বেগে ধাবমান ঝঞ্ঝা কী বিপুল ধ্বংস ও হাহাকার লইয়া হাজির হইত, ভাবিলেও শিহরন জাগে। এই রাজ্যে বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকাঠামোই সে ভাবে তৈয়ার হয় নাই। রাজনীতি করিতে এবং বিপক্ষীয়দের কোণঠাসা করিতে ব্যস্ত শাসকরা তাহার সময় পাইবেন কখন!