Advertisement
E-Paper

বিসর্জন

একটিমাত্র কুমিরছানা থাকিলে তাহাকে যে খানিক যত্ন করা প্রয়োজন, কথাটি শেয়ালপণ্ডিতও জানিত। সেই জানায় বাহাদুরি নাই। কাণ্ডজ্ঞান থাকিলে যে কেহ বুঝিবে, সবেধন নীলমণিটিও গেলে দেখাইবার জন্যও আর কিছু পড়িয়া থাকে না। কথাটি না জানাই বরং অভিনব। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই অভিনবত্বের প্রমাণ পেশ করিল। হলদিয়ার মিত্‌সুবিশি কেমিক্যালস হইল পশ্চিমবঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগের সেই কুমিরছানা।

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১

একটিমাত্র কুমিরছানা থাকিলে তাহাকে যে খানিক যত্ন করা প্রয়োজন, কথাটি শেয়ালপণ্ডিতও জানিত। সেই জানায় বাহাদুরি নাই। কাণ্ডজ্ঞান থাকিলে যে কেহ বুঝিবে, সবেধন নীলমণিটিও গেলে দেখাইবার জন্যও আর কিছু পড়িয়া থাকে না। কথাটি না জানাই বরং অভিনব। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই অভিনবত্বের প্রমাণ পেশ করিল। হলদিয়ার মিত্‌সুবিশি কেমিক্যালস হইল পশ্চিমবঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগের সেই কুমিরছানা। এই রাজ্যে বিদেশি বিনিয়োগের প্রধান মুখ। সংস্থাটি ধুঁকিতেছে। রাজ্য সরকার তাহাকে শিল্প ও আর্থিক পুনর্গঠন বোর্ড-এর ঠিকানা বাতলাইয়াই হাত ধুইয়া ফেলিয়াছে। সরকারের দায়ের প্রশ্ন উঠিলে অর্থমন্ত্রী চিনা প্রতিযোগিতার কথা বলিতে পারেন। প্রত্যুত্তরে তাঁহাকে হলদিয়া বন্দরের অব্যবস্থার কথা বলা চলে, সেখানে রাজনৈতিক তাণ্ডবে এবিজি গোষ্ঠীর বিদায়ের ফলে মাল খালাসের জন্য অযৌক্তিক অপেক্ষার কথাও শুনাইয়া দেওয়া যায়। কিন্তু, সেই তর্কে প্রবেশ করিবার প্রয়োজন নাই। গুজরাত যাহা পারে, পশ্চিমবঙ্গ পারিবে না, ইহা স্বতঃসিদ্ধ হইয়াছে। অতএব, সরকারি খয়রাতির অর্থ জোগাইতে মিত্রমহাশয় যে বিচিত্র ‘প্রবেশ কর’ চালু করিয়াছিলেন, মিত্‌সুবিশি কেমিক্যালস-কে তাহার দায় বহিতে হইতেছে। এই অহৈতুকী করটি যে শুধু দার্শনিক ভাবে আপত্তিকর, তাহা নহে, ইহা রাজ্য-সম্ভাবনার পরিপন্থী। গুজরাতে পেট্রো-রাসায়নিক সংস্থা এই করে ছাড় পায়, কিন্তু এই রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ। এখানে ক্লাবে খয়রাতি হইবে, ইমামরা ভাতা পাইবেন, কিন্তু বিপন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার কথা ভাবিবার সময় এবং মনোবৃত্তি সরকারের নাই।

পশ্চিমবঙ্গে যে নূতন বিনিয়োগ আসিবে না, এই কথাটি এত দিনে সিপিআইএম-এর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ন্যায় স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। যে শিল্প আছে, সেগুলিও থাকিবে, এমন উপায় শাসকরা রাখিতেছেন না। বিনিয়োগকারীরা যে আইনের শাসন চাহেন, বঙ্গেশ্বরীর সরকার তাহা দিতে অপারগ। কিন্তু, এই রাজ্যের কোনও শিল্প বিপাকে পড়িলে যে সরকার তাহার পার্শ্বে দাঁড়াইবে না, মিত্‌সুবিশি কেমিক্যালস-এর ঘটনা তাহা দেখাইয়া দিল। সংস্থাটির জন্য রাজ্য সরকার ঠিক কী করিতে পারিত, তাহা মূল প্রশ্ন নহে। সংস্থাটি সরকারের দ্বারস্থ হওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার পারিষদরা যে ভাবে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকিয়াছেন, তাহাই প্রতীকী। শিল্পের প্রতি, রাজ্যের ভবিষ্যতের প্রতি এই সরকারের মনোভাবের প্রতীক। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বার্তাটি মিত্‌সুবিশি কেমিক্যালস-এর পরিসীমায় থাকিতেছে না, তাহা বৃহত্তর বণিকমহলের নিকট পৌঁছাইতেছে। এই অসহযোগী রাজ্য সরকারের ভরসায় পুঁজি ঢালিবেন, এমন বিনিয়োগকারী কে?

কেহ বলিতে পারেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বুঝি শিল্পের কথা ভাবিবার সময় নাই। তিনি এক দিকে সারদা আর অন্য দিকে খাগড়াগড় সামলাইতে ব্যস্ত। কিন্তু, তাহা নহে। বিনিয়োগকারীদের লইয়া তাঁহার প্রমোদতরী ভাসাইবার ব্যবস্থা পাকা। তাহাও এক বার নহে, দুই বার। শোনা যাইতেছে, প্রথম বারে কেহ তেমন আগ্রহী না হওয়ায় দ্বিতীয় যাত্রার ব্যবস্থা হইয়াছে। বিনিয়োগকারীরা গত সাড়ে তিন বত্‌সরে বুঝিয়াছেন, বিজয়া সম্মেলনীই হউক কি নৌবিহার, কলিকাতায় হউক বা মুম্বইয়ে, সরকারের সহিত কোনও আলোচনাতেই এই রাজ্যের বিনিয়োগ-পরিবেশ বদলাইবার নহে। সম্মেলনে মিষ্টিমুখ হয়, গানও, কিন্তু সেই অখণ্ড আনন্দোত্‌সবে বণিকমহলের দৃশ্যত রুচি নাই। তাঁহারা কাজের কথায় আগ্রহী। সেই কাজের কথা আবার মুখ্যমন্ত্রীর মর্জিবিরুদ্ধ। ফলে, যে সাগরের জলে মুখ্যমন্ত্রীর প্রমোদতরী ভাসিবে, রাজ্যের শিল্প-ভবিষ্যত্‌ সেই জলেই বিসর্জিত হইয়াছে। সেই সমাপ্তিতে যেন কাহারও সংশয় না থাকে, তাহা নিশ্চিত করিতেই বুঝি মিত্‌সুবিশি কেমিক্যালস-এর সহিত এমন চর্চিত অসহযোগিতা।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy