এ দেশে রাজপুরুষের আসন টলে, ভদ্রাসন টলে না। জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রীরা তাঁহাদের সরকারি আবাসের উপর আইনি বা নৈতিক অধিকার হারাইবার পরেও সেই ঠিকানা দখল করিয়া বহাল রহিয়াছেন, এমন দৃষ্টান্ত এতই বহুলপ্রচলিত, যে কেহ সত্য সত্যই আবাস ছাড়িলে তাহা রীতিমত সংবাদ হয়। যেমন সংবাদ হইয়াছেন লালু প্রসাদ। তেরো বছর আগে যখন তাঁহার জন্য দিল্লিতে সরকারি বাংলো বরাদ্দ হয়, তখন তিনি রাজ্যসভার সদস্য। অতঃপর প্রথম ইউপিএ সরকারের আবির্ভাব এবং সাংসদের বাংলো মন্ত্রীর বাংলোয় রূপান্তরিত। ২০১৩ নভেম্বরে দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কারণে তাঁহার সাংসদের পদটি যায়। স্বাভাবিক নিয়মে পত্রপাঠ বাংলো ছাড়িয়া দিবার কথা। কিন্তু রাজধানীর ভিআইপি মহল্লায় ৭ হাজার বর্গমিটার এলাকায় ছড়ানো আবাস, তদুপরি, ওই নিবাস হইতে ‘নাতনিদের স্কুলটি কাছে’। সুতরাং নানা উপায়ে ও নানা কৌশলে লালু প্রসাদ তুঘলক রোডে অচল ছিলেন। অবশেষে ২০১৪ নভেম্বরে উচ্ছেদের নোটিস জারি হইয়াছে, কয়েক দিন আগে ভূতপূর্ব মন্ত্রী ও সাংসদ বাংলো ছাড়িয়াছেন।
একা লালুপ্রসাদকে দোষ দিলে অন্যায় হইবে। এ ধরনের বাইশ জন রাজপুরুষ কোনও ভাবেই রাজ্যপাটের সহিত যুক্ত না থাকিয়াও কেবল অতীতের জের টানিয়া দিল্লির ভিআইপি সরকারি নিবাস দখল করিয়া রাখিয়াছিলেন। এই মর্মে সুপ্রিম কোর্টের কাছে অভিযোগও দায়ের করা হয়। পূর্ত বিভাগকে তো সকল নির্বাচিত সাংসদেরই বাসস্থানের বন্দোবস্ত করিতে হয়। সেখানে যাঁহারা নির্বাচনে পরাস্ত হইয়া ওই নিবাসগুলিতে থাকার অনধিকারী, তাঁহাদের বাড়িগুলি খালি করিয়া দিতে বারংবার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু নানা অজুহাতে তাঁহারা থাকিয়া যান। অজিত সিংহ যেমন ভোটে হারিবার পরেও তাঁহার মন্ত্রি-নিবাস এই যুক্তিতে ছাড়েন নাই যে, ওই স্থলে তিনি পিতা চৌধুরী চরণ সিংহের নামে একটি স্মারক বানাইবেন, কারণ ছয় মাসের প্রধানমন্ত্রী চরণ আমৃত্যু ওই বাংলোয় বাস করিয়াছেন। চৌধুরী দেবীলালও এক বার কিছু কালের জন্য ‘উপ-প্রধানমন্ত্রী’ হইয়া সেই যে মন্ত্রী-নিবাসে থানা গাড়েন, পৌনঃপুনিক তাগাদাতেও তাঁহাকে সেখান হইতে সরানো যায় নাই।
পূর্ত দফতর যখনই সরকারি নিবাসের অনধিকার দখলকারীদের উচ্ছেদের নোটিস ধরাইতে চেষ্টা করিয়াছে, তখনই বিরোধী দলগুলির রাজনীতিকরা প্রতিবাদ করিয়াছেন। রাজ্যসভায় গত ১ ডিসেম্বর প্রশ্নোত্তর পর্বও বিরোধী নেতারা বানচাল করিয়া দেন এই প্রশ্নে। অথচ এ ভাবে জনগণের অর্থে তৈয়ার ও রক্ষণাবেক্ষণ হওয়া সরকারি ভবন বা নিবাসগুলিতে জনাদেশে প্রত্যাখ্যাত কোনও রাজনীতিকের দখলে রাখার কোনও অধিকারই থাকিতে পারে না। নরেন্দ্র মোদীর সরকার এই প্রশ্নে আগেকার সরকারগুলির তুলনায় অপেক্ষাকৃত কঠোর ও অনমনীয় হওয়াতেই বিরোধীদের শোরগোল। অথচ এই কঠোরতাকে সমর্থন করাই সমস্ত সাংসদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল। তাহার জন্য অবশ্য যথার্থ গণতান্ত্রিক চেতনা থাকা আবশ্যক। সে বস্তুটি ভারতে আজও সুলভ নহে।