Advertisement
E-Paper

‘মানিকবাবু নাকি আপনার প্রেমে পড়েছিলেন?’

নারী স্বাধীনতা, প্রেমের গল্প, এ সব দিয়ে নয়। বুদ্ধদেব বসুর সহধর্মিণী হিসাবেও নয়। মধ্যবিত্তের রুচিনির্মাণ, নিউক্লিয়ার পরিবারে নারীর ক্ষমতায়ন, এ সব দিয়েই বরং এ বার দেখা যাক প্রতিভা বসুকে। তাঁর জন্মের একশো বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ।মাস কয়েক আগে আলিয়া ভট্টের হিট ছবি হাইওয়ে দেখতে গিয়ে আচমকা প্রতিভা বসুকে মনে পড়ে গিয়েছিল। ‘স্টকহল্ম সিনড্রোম’, মানে অপহৃত নায়িকা কী ভাবে অপহরণকারীকেই ভালবেসে ফেলে, তা নিয়ে গল্প। সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আচমকা মনে পড়ল, আরে! প্রতিভা বসুর উপন্যাস অবলম্বনে উত্তম-সুচিত্রার আলো আমার আলো ছবিটাও তো প্রায় এক রকম। শেষ দৃশ্যে সুচিত্রা জড়িয়ে ধরছেন অপহরণকারী উত্তমকুমারকে।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৫ ০০:২২
বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে। ছবি: কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সৌজন্য: দময়ন্তী বসু সিংহ

বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে। ছবি: কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সৌজন্য: দময়ন্তী বসু সিংহ

মাস কয়েক আগে আলিয়া ভট্টের হিট ছবি হাইওয়ে দেখতে গিয়ে আচমকা প্রতিভা বসুকে মনে পড়ে গিয়েছিল। ‘স্টকহল্ম সিনড্রোম’, মানে অপহৃত নায়িকা কী ভাবে অপহরণকারীকেই ভালবেসে ফেলে, তা নিয়ে গল্প। সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আচমকা মনে পড়ল, আরে! প্রতিভা বসুর উপন্যাস অবলম্বনে উত্তম-সুচিত্রার আলো আমার আলো ছবিটাও তো প্রায় এক রকম। শেষ দৃশ্যে সুচিত্রা জড়িয়ে ধরছেন অপহরণকারী উত্তমকুমারকে।

সেই ছবিতে উত্তমকুমার সকালে জনদরদি নেতা, রাতে নারীমাংসভুক ভিলেন। সুচিত্রা সেন কলোনির উদ্বাস্তু মেয়ে, টাকার লোভে বাবা কানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে উত্তমের সাঙ্গোপাঙ্গদের হাতে তুলে দেন। প্রতিভা বসু মুখ্যত প্রেমের গল্প লেখক, পিতৃতন্ত্রের বিরোধিতায় কোনও দিন নামেননি, জানা ছিল। কিন্তু ভিলেন রাজনৈতিক নেতা, দারিদ্রের চাপে মেয়ে বিক্রির খেই পঞ্চাশের দশকে লেখা উপন্যাসেও রেখে গিয়েছেন? ঝাঁকুনি লাগল আরও একটা জায়গায়। বাংলা ছবিতে উত্তমকুমারের ডেরায় সুচিত্রা অসুস্থ হন, স্মৃতিভ্রংশ ঘটে। অতঃপর সেই মেয়ের সেবা ও চিকিৎসায় নায়ক স্বয়ং। মান্না দে গেয়ে ওঠেন, ‘এত আলো এত আকাশ, আগে দেখিনি।’ বাঙালির জাতীয়তাবাদে একদা নারীর সেবা, মাধুর্য ইত্যাদি অনেক আপ্তবাক্য ছিল। পুরুষ কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়বে, নারী সেবা করবে। প্রতিভা বসু কি তাঁর জনপ্রিয় গল্পে সেই ছকে ঘটিয়েছিলেন নিঃশব্দ বিপর্যাস? নইলে তাঁর লেখা থেকে তৈরি পথে হল দেরী ছবিতেও কেনই বা উত্তমকুমার সেবা করবেন অসুস্থ সুচিত্রাকে? পাল্টে যাচ্ছিল নাগরিক প্রেমের ভাষা? সেখান থেকেই লেখিকার অন্তর্ঘাত?

মনে পড়ে গেল সমুদ্রহৃদয় উপন্যাস। দাঙ্গার সময় অপহরণকারী মুসলিম যুবকের প্রতি নায়িকার প্রেম। অতঃপর হিন্দু পাড়ায় নায়িকাকে পৌঁছে দিতে এসে নায়ক খুন। রিজওয়ানুর কাণ্ডের পঞ্চাশ বছর আগে লেখা সুমিত্রার অপমৃত্যু গল্পে মুসলিম যুবকের সঙ্গে নায়িকার প্রেম, লুকিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে। অতঃপর পুলিশ নিয়ে বাবার মেয়েকে ছিনিয়ে আনা। ছক প্রেমের গল্পেরই, কিন্তু ভিতরে ধর্মীয় উন্মত্ততার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। মনে পড়ছে, তাঁর ঘরের তাকে ছিল ছোট্ট এক লক্ষ্মীমূর্তি, বাড়িতে রান্না হত বিফ কাবাব। যে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীতে গোমাংস নিষিদ্ধ করা হয়, সেখানে মা লক্ষ্মী আর বিফ কাবাবের সহাবস্থান চেনা ছকে আঁটবে না।

আজ একশো বছর পূর্ণ হচ্ছে তাঁর জন্মের। আমি তাঁকে চিনেছিলাম তুলনামূলক সাহিত্যে আমার অন্যতম প্রিয় মাস্টারমশাই, তাঁর অকালপ্রয়াত পুত্র শুদ্ধশীল বসুর মা হিসেবে। তত দিনে অ্যান্টি র্যাবিস ইঞ্জেকশনের দৌলতে তাঁর পা অসাড়, ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে হয়। বুদ্ধদেব বসু বেঁচে থাকতে থাকতেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। কিন্তু আশির দশকেও গদু নামে হৃষ্টপুষ্ট এক নেড়ি কুকুর তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। তাঁর খণ্ড কাব্য গল্পটি পড়ে এক বার প্রশ্নও করেছিলাম, ‘লোকে বলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি আপনার প্রেমে পড়েছিলেন?’ মাসিমা হেসেছিলেন, ‘হ্যা।ঁ এক বার তো বলেছিলেন, শনিবারের চিঠি আপনার নামে আজেবাজে লিখেছে। যাই, ব্যাটাকে মেরে আসি।’ সব কিছু চেপে রাখা বাঙালি সমাজে অকালপক্ব এক ছোকরা মাস্টারমশাইয়ের মাকে প্রেম নিয়ে প্রশ্ন করছে এবং তিনি উত্তর দিচ্ছেন! তাঁর আয়না গল্পটি সম্প্রতি আবার পড়ে চমকে উঠলাম। নাতনি এবং দিদিমার প্রেমের অভিজ্ঞতার আদানপ্রদান। দিলদার নামে এক কবির প্রতি ছেলেবেলায় দিদিমার ইনফ্যাচুয়েশন তৈরি হয়, পাড়ার ছেলেদের হাতে মার খান তিনি। প্রতিভা বসুর ছেলেবেলায় কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে এই রকম ঘটনাই ঘটেছিল। কিন্তু নজরুলের অনুষঙ্গ নয়, চমক লাগল অন্য কারণে। গল্পের শেষে দিদিমা নাতনিকে বলছেন, ‘সুমনকাকাকে যে তোমার ভাল লাগে, সেটাও ভালবাসা নয়। গন্তব্যে পৌঁছানোর অনেকগুলোর মধ্যে একটা তীরক্ষেপ। একদিন আসল তীরন্দাজ আসবে, তাকে চিনতে পারবে।’

প্রতিভা বসুর চরিত্ররা বেশির ভাগই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতার মতো শরিকি বাড়িতে, স্যাঁৎসেঁতে শ্যাওলা-পড়া কলঘরে তাদের জীবন কাটে না। সমসাময়িক সাবিত্রী রায় বা সুলেখা সান্যালের মতো প্রতিবাদী ধাঁচাও তাঁর নয়। তাঁকে দেখতে হবে আমাদের আধুনিকতা প্রকল্পের ঘরোয়া পরিসরে। আধুনিকতার বর্ণনায় এই বঙ্গে জাতীয়তাবাদ, ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে যত শব্দ খরচ হয়েছে, রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া, ঘর সাজানো, রুচির পারিপাট্য নিয়ে তার সিকিভাগও নয়। বুদ্ধদেব ও প্রতিভা বসু বিয়ের পর বাড়ি খুঁজছেন, সঙ্গী সমর সেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেরও আগের কথা সেটা। উপনিবেশের পুরুষ একাই শহরে বাসা খুঁজতেন, পরে স্ত্রীকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসতেন। আত্মজীবনীতে প্রতিভা লিখছেন, ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের বাড়িটা তাঁদের পছন্দ হল। কারণ রান্নাঘরে চিমনিওয়ালা উনুন, ধোঁয়ার ব্যাপার নেই। বাথরুমে বাথটাব। দুই ঘরে দুটি সিলিং ফ্যান।

শিশুকন্যাকে নিয়ে পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যান লেখক দম্পতি। ঠাকুর চাকর লোকলস্কর পরিবৃত হয়ে জমিদারি চালে এক মাসের জন্য গিরিডি, মধুপুর নয়। বরং কখনও ওয়ালটেয়ার, কখনও দার্জিলিং। দিন কয়েকের জন্য হোটেলে থাকেন। স্ত্রীর লাগেজে ছোট্ট স্পিরিট স্টোভ, বেতের বাস্কেট, চায়ের ফ্লাস্ক। আজকের বাঙালি কি এই মধ্যবিত্ত আধুনিকতার উত্তরসূরি নয়? তাঁদের ছোট্ট মেয়ে হাওড়া স্টেশনে কুলির কোলে ঝাঁপিয়ে আদর খাচ্ছে, বুদ্ধদেব হাসতে হাসতে বলছেন ‘প্রলেতারিয়েত প্রীতি’ আর প্রতিভা মেয়ের দুই গালে ডেটল তুলো দিয়ে ক্রিম মাখিয়ে দিচ্ছেন।

নিউক্লিয়ার পরিবারে স্বামী স্ত্রী মাঝে মাঝে বিকেলে রমেশ মিত্র রোড থেকে হেঁটে ময়দানে বেড়াতে যান, মাসের শুরুতে হোয়াইটওয়ে লেডল-এর দোকানে চা খান। সনাতন মার্ক্সবাদীরা এই জীবনযাত্রাকে পাতিবুর্জোয়া আখ্যা দিতে পারেন। আসল ঘটনা অন্য। সামাজিক গোষ্ঠী হিসাবে নাগরিক মধ্যবিত্ত নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে নেয় রুচিতে। শিক্ষা এবং রুচির সাংস্কৃতিক পুঁজি মধ্যবিত্তকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেয়।

নিজের লেখালিখি, স্বামী ও পুত্রকন্যাদের প্রতি দায়িত্ব পালনের মাল্টিটাস্কিং। নবনীতা দেব সেন বুদ্ধদেব বসুর সাক্ষাৎ ছাত্রী। তাঁর স্মৃতিচারণ: ‘আদরে আব্দারে রাজি করিয়ে মাসিমাকেও সিনেমায় নিয়ে যেতাম আমরা। বু.ব নিজের ঘরে আপনমনে কাজ করতেন, আমরা পাশের ঘরে উথালপাথাল আড্ডা মারতাম। মাসিমারই লেখাটা শেষ হতো না, টেবিলে পড়ে থাকত। সেলাই শেষ হতো না, মেশিনে পড়ে থাকত। পরদিন গেয়ে দেখি ম্যাজিক...সবই শেষ, সবই সম্পূণর্।’ সংসারে থেকেও সাংসারিকতায় জারিত না হওয়ার এই প্রকল্পে কি নেই আধুনিক নারীর রুচিনির্মিতি?

নির্মাণ অবশ্যই অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত। বাঙালি আধুনিকতার চরিত্রই সেটি। তাঁদের বিয়ের সময় বুদ্ধদেব বসু সাড়া, বন্দীর বন্দনা-র সাড়া ফেলা লেখক, কিন্তু রানু সোম নামের মেয়েটিও গানের জগতে বিখ্যাত। তাঁর কণ্ঠে নজরুল, দিলীপ রায়ের গানের রেকর্ড বেরোয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে গান শোনেন। সেই গায়িকার নিঃশব্দ মৃত্যু ঘটে গিয়েছে। বাড়িতে সাহিত্যের আড্ডা। সেখানে বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, কামাক্ষীপ্রসাদরা স্ত্রীকে আনেন না, বুদ্ধদেব উদার। কারও মধ্যে সাহিত্যের সামান্য সম্ভাবনা দেখলেই তিনি তুলে ধরেন, স্ত্রীর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। ‘সঙ্গীত বিষয়ে তাঁর যদি সিকি শতাংশও আগ্রহ থাকত, আমি গানের চর্চা রাখতে বাধ্য হতাম। বুদ্ধদেব বা তাঁর বন্ধুরা কখনও আমাকে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাননি,’ আত্মজীবনীতে লিখেছেন তিনি। ছকবাঁধা মন এখানে পিতৃতন্ত্রের ঔদাসীন্য খুঁজে পাবে। কিন্তু প্রতিভা পরের লাইনেই জানাচ্ছেন, তিনি প্রায় বেঁচে গেলেন। একদা বড়রা সবাই ‘খুকি একটা গান করো’ বলেই নিজেরা গল্প করতে বসে যেতেন, তার পর গল্পে মজেই ‘আর একটা গাও’ অর্ডার।

প্রতিভা বসুকে তাই দেখতে হবে নারী স্বাধীনতা, জনপ্রিয় প্রেমের গল্প, এ সব দিয়ে নয়। বুদ্ধদেব বসুর সহধর্মিণী হিসাবেও নয়। বাঁধা গতের বাইরে এসে মধ্যবিত্তের রুচিনির্মাণ, নিউক্লিয়ার পরিবারে নারীর ক্ষমতায়ন দিয়েই বরং এ বার দেখা যাক তাঁকে। শতবর্ষে সেটিই হতে পারে শ্রদ্ধার্ঘ্য।

pratibha basu anandabazar editorial gautam chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy