বিশ্বব্যাপী পরিবেশের ক্ষয়রোধে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দারুণ ভাবে ব্যর্থ। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের ইহাই সারমর্ম। ২০১০ সালে জীববৈচিত্র বিষয়ে কনভেনশন অন বায়োলজিকাল ডাইভারসিটি (সিবিডি)-র বৈঠকে পরিবেশের ক্ষয়রোধে ২০২০ সালের জন্য ২০টি লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হইয়াছিল। চার বত্সর অতিক্রান্ত, ওই ব্যাপারে কত দূর কী করা হইয়াছে? সদ্য প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি আউটলুক-৪’ প্রতিবেদন বলিতেছে, পরিবেশ ক্ষয়ে বিপন্নতম প্রাণীগুলির (নব্বই শতাংশ লেমুর প্রজাতি, বিশেষ জিরাফ, বেশ কিছু পাখি) পক্ষে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে। অন্য বেশ কিছু প্রাণীর বিলোপের বিপদ কমে নাই। সিবিডি নির্ধারিত কুড়িটি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মাত্র পাঁচটি অর্জনের উদ্যোগ প্রত্যাশিত বেগে ধাবমান। বাকি লক্ষ্যে কর্মোদ্যোগ হয় প্রয়োজনের তুলনায় ধীরগতি, নয় প্রায় অনুপস্থিত। একটি লক্ষ্য ছিল বিপন্ন প্রজাতিগুলির আপন বাসস্থান বিনাশের বিপদ ৫০ শতাংশ কমানো। লক্ষ্য পূর্ণ হইবে না। বিশ্বব্যাপী অরণ্যক্ষয়ের বাত্সরিক হার কমিতেছে বটে, কিন্তু তাহা এখনও বিপজ্জনক মাত্রায়। মাত্রাতিরিক্ত মত্স্য সংগ্রহের ধাক্কায় সামুদ্রিক প্রাণিকুলের নাভিশ্বাস উঠিয়াছে। এই রিপোর্ট এক মূর্তিমান বিপদসংকেত।
সমীক্ষাটি এক গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে। এই জগতের এক নিয়ম, এক বড় সত্য আবিষ্কার করিয়াছিলেন চার্লস ডারউইন। প্রাকৃতিক নির্বাচন হেতু জীবের বিবর্তন। প্রাণিরাজ্যে জীবনযুদ্ধে জয়পরাজয়ের মূলে কারণটি কী, তাহা নির্ণীত হইয়াছে ডারউইনের তত্ত্বে। যাহার নির্যাস: বংশবৃদ্ধি জীবের ধর্ম, কিন্তু ওই গুণই তাহার পৃথিবীতে টিকিয়া থাকিবার একমাত্র পাথেয় নহে। জীবনধারণ যেহেতু প্রাকৃতিক সম্পদ-নির্ভর, এবং সেই সম্পদ যেহেতু অসীম নহে, সেহেতু জীবের বংশধরেরা সবাই টিকিয়া থাকিতে পারে না। পারে তাহারাই, যাহারা অপ্রতুল সম্পদ— এবং অবশ্যই প্রতিকূল পরিবেশে— নিজেদের খাপ খাওয়াইতে পারে। অর্থাত্ জীবনযুদ্ধে মূল নির্ণায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পরিবেশ। দেখা যাইতেছে, পরিবেশ নিজে আর পূর্বের ন্যায় শক্তিশালী নহে। খোদকারি করিয়া তাহাকে বিনষ্ট করিতেছে মানুষ। যাহার পরিণামে বহু জীবের সর্বনাশ অথবা বিলুপ্তি।
অর্থাত্ বিবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রকৃতি আর মূল নির্ণায়ক নহে। তাহা বরং মানুষ নামক স্বঘোষিত উন্নততম প্রাণী। যাহার একমাত্র চিন্তা আপন সুখ-সমৃদ্ধি। কাল কী ঘটিবে, তাহা ভাবিতে সে অনিচ্ছুক। সে বাঁচিয়া থাকিতে চাহে শুধু আজ। ভবিষ্যত্ চিন্তা জলাঞ্জলি দিয়া এই যে অন্ধ অগ্রগমন, ইহা কি উন্নত বুদ্ধির লক্ষণ? পরিবেশবাদীর সমালোচনায় কর্ণপাত করিবার অবকাশ অধিকাংশ মানুষের নাই। সে ব্যাপারে খেদ আপাতত উহ্য থাকুক, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের বিচারে একটি প্রশ্ন অপরিহার্য। নির্ণায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়া বিবর্তন প্রক্রিয়াটিকে মানুষ যে হারে ত্বরান্বিত করিতেছে, তাহার পরিণাম শুভ না অশুভ? কট্টর বিবর্তনবাদীরা বলিবেন, প্রকৃতি বদলে মানুষ নির্ণায়কের ভূমিকা গ্রহণ করিলে ক্ষতি কী? যাহা ঘটিবে, তাহা তো শেষ বিচারে পরিবর্তন বই অন্য কিছু নহে। যুক্তি হিসেবে শ্রবণযোগ্য হইলেও, দাবিটি গ্রহণযোগ্য নহে। বরং এ কথা বলা যায় যে, নির্ণায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়া মানুষ বিবর্তন প্রক্রিয়াটিকে এক প্রকাণ্ড অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলিয়া দিতেছে। অনিশ্চয়তার অর্থ: সুখ ও দুঃখের সম্ভাবনা ৫০:৫০।