প্রসার। নির্বাচনী জনসভায় নরেন্দ্র মোদী। ধমনগাঁও, অমরাবতী, মহারাষ্ট্র। ছবি: পিটিআই
সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তবু মহারাষ্ট্রে আগামী পাঁচ বছর ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারই শাসন করতে চলেছে। একটা ‘সম্পর্ক’ দরকার এর জন্য; সেটা ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি)-র ‘লিভ-ইন’ সম্পর্ক, না সদ্য-বিচ্ছিন্ন শিবসেনার পুনর্বার বিবাহ-প্রস্তাব, তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা তুঙ্গে। রাজনৈতিক দড়ি-টানাটানির মধ্যে মাঝখান থেকে শিবসেনাকেই অনেকটা জমি ছেড়ে দিতে হচ্ছে ক্ষমতা ভাগাভাগির খেলায়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আসছেন নরেন্দ্র মোদীর প্রিয় নেতা, রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখ, নাগপুরের দেবেন্দ্র ফডণবীস।
সব মিলিয়ে মহারাষ্ট্র রাজনীতিতে একটা আমূল বিপ্লব ঘটে গেল বললে ভুল হবে না। ১৮৮৫ সালে যখন প্রথম বার মুম্বইতে কংগ্রেসের নামে এক ঐতিহাসিক জমায়েত হয়েছিল, সেই সে দিন থেকে কংগ্রেসের দুর্গ হয়ে থেকেছে এই রাজ্য। ঊনবিংশ শতকে বাংলার নবজাগরণ পশ্চিমমুখী যাত্রায় পৌঁছেছিল মহারাষ্ট্রে। এই প্রদেশটিতে দ্রুত প্রগতিমুখী ধর্মীয় আন্দোলন তৈরি হয়ে উঠেছিল, যার নাম সত্যশোধক সমাজ। ব্রাহ্মণদের আধিপত্য ও বেদ-ধর্মসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শাণিত হয়ে উঠেছিল এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। লক্ষণীয়, সেই শোধনবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রামীণ সমাজের মধ্যেও। তাই, এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে, এই প্রদেশেই যে এক দিন বি আর অম্বেডকর জন্ম নেবেন, সেটা প্রায় যেন প্রত্যাশিতই বলা চলে। আবার, ভারতের সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের অনেক পৃষ্ঠপোষক যে মহারাষ্ট্র থেকেই উঠে এসেছিলেন, সেটাকেও কাকতালীয় বলা যায় না। মুসলিম সত্যশোধক সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হামিদ দালওয়াই, মুসলিম মৌলবি সম্প্রদায়ের রক্তচক্ষুর সামনে যিনি পাল্টা চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছিলেন। মনে রাখা দরকার, তিনিও কিন্তু মহারাষ্ট্রের মানুষ। ভি ডি সাভারকর বা হিন্দু মহাসভা বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (প্রাক্তন জনসঙ্ঘ) এবং ভারতীয় জনতা পার্টি— ‘হিন্দুত্ব’ ঘরানাকে আটকে রাখার নানা রকম চেষ্টা করেছেন এখানকার প্রগতিশীল নেতারা, সফলও হয়েছেন। ১৯৮০ সালে বিজেপি ছিল শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দল, ভোট শতাংশ ছিল ৭ থেকে ৯। ১৯৯০ সালে ১০ ছুঁল সংখ্যাটা, তা-ও আবার শিবসেনার সঙ্গে জোট বাঁধার ফলে, এবং আরও বিশেষ ভাবে, শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরের জনমোহন নেতৃত্বের সৌজন্যে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে বিজেপির ভোট দাঁড়াল ১৪ শতাংশের কাছাকাছি। আর এই সাম্প্রতিক প্রাদেশিক নির্বাচনে, শিবসেনার সঙ্গে যোগাযোগ-বিহীন ভাবে বিজেপি পেল ২৮ শতাংশ ভোট।
পুণের সাবিত্রীভাই ফুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রনীতির অধ্যাপক সুহাস পালসিকর বলছেন, বিজেপির এই ভোট-উত্থানের প্রধান কারণ, শহুরে অঞ্চলের বাইরে বেরনোর চেষ্টা। তাঁর মতে, ১৯৯০ থেকে শিবসেনার সঙ্গে বন্ধুত্বের ফলে বিজেপি যে ধারাবাহিক ভাবে উপকৃত হয়েছে, সেটাও ভোটের ক্রমোত্থানে প্রতিফলিত।
উল্টো দিকে, কংগ্রেসের ভোট নিয়মিত ভাবে কমছে। ১৯৮০ সালে ৪৪.৫ শতাংশ থেকে এ বারের ১৮ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ দলাদলির রাজনীতি চিরকালই কংগ্রেসের প্রধানতম শত্রু, বিশেষত শরদ পওয়ারের মতো নেতাদের দৌলতে, যাঁরা সোজা দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে এনসিপি-র মতো আলাদা দল তৈরি করে ফেলেন। বিজেপি অবশ্যই এই ধরনের পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাতে তত্পর। লক্ষণীয়, শিবসেনা ছাড়া বিজেপি-ই কিন্তু একমাত্র দল, যাদের প্রাদেশিক ভিত্তিতে দলীয় সংগঠন রীতিমত চোখে পড়ার মতো। বিজেপির ক্ষেত্রে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, পার্টির লোকেরা পার্টির জন্য খাটাখাটনি করে, কেবল নেতার জন্য খাটে না।
এ দিকে কংগ্রেস ও এনসিপি দুই পক্ষই তাকিয়ে ছিল মরাঠা-কুন্বি ভোটব্যাঙ্কের দিকে। কিন্তু নির্বাচনী ফল বলছে, চতুর্মুখী ভোটযুদ্ধে দুই গেরুয়াবাদী দল বিজেপি ও শিবসেনা কিন্তু মরাঠা-কুন্বি ভোটে ভাল মতোই ভাগ বসিয়েছে। পশ্চিম মহারাষ্ট্রের চিনি-বলয়ে কংগ্রেস ও এনসিপির একটা নেটওয়ার্ক ছিল: চিনি কল, ডেয়ারি কোঅপারেটিভ, আঞ্চলিক স্বশাসিত বলয়, এই সব। দেখা যাচ্ছে বিজেপি কিন্তু এ বার সেই অঞ্চলে ১৯টি আসন পেয়েছে। শিবসেনার আসনও ২০০৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণ: ৬ থেকে সোজা ১২। খরাবিধ্বস্ত মরাঠাবড়া অঞ্চলে বিজেপি ২০০৯ সালে মাত্র ২টি আসন পকেটে পুরেছিল, এ বার সেটা দাঁড়িয়েছে ১৫। শিবসেনা পেয়েছে ১১টি। আর কংগ্রেস ও এনসিপি? দুই পক্ষেই আসনসংখ্যা নেমে এসেছে এক ঘরের সংখ্যায়। উত্তর মহারাষ্ট্রেও ছবিটা ঠিক এক রকম, অথচ সেখানে জনজাতি-বর্গীয় মানুষ প্রায় ৩০ শতাংশ। বিজেপি সেখানে মোট ৪৭টি আসনের ১৯টি পেয়ে গিয়েছে একনাথ খাড্সে-র মতো দক্ষ নেতার কল্যাণে। কোঙ্কনের উপকূল অঞ্চল চিরকালই শিবসেনার দুর্গ বলে পরিচিত, মুম্বই মহানগরীর কলকারখানার শ্রমিক সব এই জায়গা থেকেই আসা-যাওয়া করে বলে। এখানে মোটামুটি ৩০টি আসনের মধ্যে শিবসেনার ভাগে গিয়েছে ১৪, আর বিজেপি-র ভাগে, ১০। সব ক’টি বড় শহরে বিজেপির জয়জয়কার। মুম্বইতে বিজেপি ১৫ আসনের অধিকারী, শিবসেনা ১৪টির। বিজেপি-র প্রার্থীদের ভোট-মার্জিনই বলে দিচ্ছে যে, তারা মরাঠি ভোটও যথেষ্ট পরিমাণে টেনে নিতে পেরেছে। তফশিল-ভুক্ত জাতি ও জনজাতির নির্বাচকমণ্ডলী প্রধানত কাদের জিতিয়েছে? বিজেপি ও শিবসেনা।
রাজ্যের ‘প্রগতিশীল’ অংশের অভিভাবকত্ব করার যে দাবি কংগ্রেস করে, তার প্রধান ভরটা সাধারণত থাকে মরাঠা-কুন্বি ভোটের উপর। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, সেই ভোটব্যাঙ্কের মধ্যেই পড়ত অন্যান্য অনুন্নত সম্প্রদায় ও দলিতরা। তবে তার মধ্যেও একটা বার্তা ছিল পরিষ্কার। কংগ্রেসই হোক আর এনসিপি, নেতারা কিন্তু স্পষ্ট ভাবে মরাঠা-কুন্বি পরিচিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এক দিকে পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ (কংগ্রেস), অন্য দিকে অজিত পওয়ার (এনসিপি)। মুক্ত অথর্নীতির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কো-অপারেটিভগুলির ক্ষমতা ও প্রাসঙ্গিকতা কমতে শুরু করে, সরকারি সহায়তাও দ্রুত হারে কমতে থাকে। বেসরকারি চিনিকলগুলি আখের জন্য ভাল দর দিতে শুরু করে, আখচাষিদের জন্য আগের চেয়ে অনেক ভাল পরিষেবাও তারা দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, আখচাষের বড় বড় কো-অপারেটিভ ‘ব্যারন’রা ক্রমশ নিজেরাই বেসরকারি চিনি কল তৈরি করতে লেগে যায়। অনেক দিন ধরে কংগ্রেস ও এনসিপি, দুই দলই প্রাদেশিক কৃষিজগতের এই সব সামন্তপ্রভুদের দল, শহরের অধিবাসীরা তাদের সেই ভাবেই দেখে এসেছে, এবং এই জন্যই শহরে তাদের প্রতি একটা স্পষ্ট বিরূপতা তৈরি হয়েছে। তারা যেন সামন্তজগতের প্রতিনিধি, আর বিজেপি ও শিবসেনা হল ‘প্রগতিশীল শক্তি’র মুখ! উল্টো দিকে, বিজেপি অ-মরাঠা মুখগুলিকে নিয়মিত ভাবে নেতৃত্বের আসনে আনতে শুরু করে, গডকরী, ফডণবীস, মুঙ্গান্তিবাড়, খাড্সে ইত্যাদি। বামভাবাপন্ন দলগুলিকে তো আগেই বাজার অর্থনীতি অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছে। মুম্বই এক কালে ছিল কারখানার শহর, ‘মিল সিটি’। এখন মুম্বই ‘মল সিটি’। এত দিনের কংগ্রেস-এনসিপি সরকার ভাবতেই পারে যে মরাঠা-কুন্বি ও মুসলিমদের জন্য তারা সংরক্ষণ বাড়িয়ে যাবে। কিন্তু সেটা দিয়ে তাদের ভোটব্যাঙ্ক বাড়ানোর আশা যে দুরাশা, সেটা এ বার প্রমাণিত হল।
এত সবের পর অবশ্য একটা ছোট প্রশ্ন থেকেই যায়। কেন বিজেপি-কে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস আর এনসিপি থেকে মোট প্রার্থীর এক-তৃতীয়াংশ আমদানি করতে হল? রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯২৫ সালে, সে দিন থেকে আজ পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে যে এই দল রাজ্য জুড়ে ব্লক স্তরের নেতৃত্বও তৈরি করে উঠতে পারেনি, সেটাকে নিশ্চয়ই দুর্ভাগ্য বলেই ধরতে হবে! ঠিক এই জায়গাটাতেই বিজেপি-র সত্যিকারের দুর্বলতা, যাকে বলে ‘অ্যাকিলিসের গোড়ালি’! ভবিষ্যতে যদি এই নড়বড়ে গোড়ালির কারণেই সাফল্যের চূড়া থেকে তাকে গড়িয়ে নীচে পড়তে হয়, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy