অশান্তির হাইফেন অনেক চেষ্টাতেও দূর হয় নাই, এ বার তাহার সহিত যোগ দিল শান্তির হাইফেন। মার্কিন, ও তাহার অনুসারী আন্তর্জাতিক, কূটনীতিতে ভারত-পাকিস্তানকে গাঁটছড়া-বাঁধা দুই রাষ্ট্র হিসাবে দেখিবার অভ্যাস অতীতের তুলনায় কিছুটা কমিয়াছে, ভারতীয় অর্থনীতির আপেক্ষিক সাফল্য এবং ভারতীয় বিদেশ নীতির পরিণতিপ্রাপ্তির যৌথ ক্রিয়াতেই কমিয়াছে, ওয়াশিংটন হইতে রাষ্ট্রীয় অতিথি দিল্লিতে পদার্পণ করিলেই ইসলামাবাদেও তাঁহার উড়োজাহাজ নামিবেই এমনটা আজ আর অবধারিত নহে। তাহার পরেও অবশ্যই থাকিয়া থাকিয়া যুগলাঙ্গুরীয় পরাইয়া দেওয়ার নূতন উদ্যোগ দেখা যায়। কাশ্মীরে মেঘ ঘনাইলেই, সীমান্তে গুলিবিনিময় শুরু হইলেই ‘ভারত-পাকিস্তান’ সংকটের কাহিনি গীত হইতে থাকে, বিল ক্লিন্টনের উত্তরসূরিরা সেই কাহিনিতে ‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’ চিহ্নিত করিতে তৎপর হন। ইসলামাবাদ এই হাইফেনটিকে বরাবরই পরমাদরে ধরিয়া রাখিতে চাহিয়াছে, এখনও তাহাই চাহে, কারণ এতদ্দ্বারা তাহার গুরুত্ব লালিত হয়, এফ-সিক্সটিনাদি প্রাপ্তিযোগও। দিল্লীশ্বররা বন্ধনী মুছিতে চাহেন, কারণ উপমহাদেশের শৃঙ্খল না ছিঁড়িলে বৃহত্তর পৃথিবীতে ভারতের উত্তরণ ব্যাহত হইতে থাকিবে।
এই অবস্থাতেই নূতন বন্ধনী সরবরাহ করিলেন সুইডিশ অ্যাকাডেমি। নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নূতন হাইফেন বসাইয়া দিলেন তাঁহারা। যাঁহারা পুরস্কার পাইলেন, তাঁহাদের ব্যক্তিগত কৃতি এখানে অ-প্রাসঙ্গিক, যে ভাবে তাঁহাদের পুরস্কার প্রদানের সূত্রে তাঁহাদের দুই দেশকে একত্র করা হইল, ব্যক্তি অপেক্ষা রাষ্ট্রকেই অধিক গুরুত্ব দিলেন নির্বাচকরা, আপত্তি সেখানেই। স্ত্রীশিক্ষার উপর তালিবানি আক্রমণের বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান কিংবা শিশুশ্রম বন্ধ করিবার সামাজিক লড়াই কোনওটিই কেন শান্তি পুরস্কারের উপজীব্য হইবে, তাহা আদৌ স্পষ্ট নহে। কিন্তু সেই তর্ক মুলতুবি রাখিলেও প্রশ্ন ওঠে: দুইটি বিষয় তো স্বতন্ত্র, এমন দুইটি স্বতন্ত্র বিষয়ে কেন একযোগে একটি নোবেল পুরস্কার দেওয়া হইল? বস্তুত, নোবেল পুরস্কারের পরম্পরায় একই বৃন্তে একাধিক ফুল বিস্তর ফুটিয়া থাকে, কিন্তু এমন একাধিক বৃন্তের অভিজ্ঞতা নিতান্ত বিরল। কোন যুক্তিতে দুই বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করিয়া মালালা এবং কৈলাস সত্যার্থী একই বছরের শান্তি পুরস্কার পাইলেন?
স্পষ্টতই, হাইফেনের যুক্তি। এবং সেই কারণেই প্রশ্ন: কী জঙ্গি মৌলবাদের বিরোধিতা, কী শিশুশ্রমের বিরোধিতা, উভয় ক্ষেত্রেই তো বন্ধনীতে বসাইবার মতো বহু দেশের বহু নাগরিক মিলিত, এই দুই ক্ষেত্রেই দুনিয়ার নানা অঞ্চলে অনেক মানুষ কাজ করিতেছেন, বাছিয়া বাছিয়া ভারত এবং পাকিস্তান হইতেই দুই প্রাপককে মিলাইলেন, তাঁহারা মিলাইলেন? ইহা নিছক রাজনীতি, এবং উচ্চাঙ্গের রাজনীতি নহে। উন্নত দুনিয়া যে এই রাজনীতি করিয়া থাকে, তাহা সেই দুনিয়ার চালকদের অহমিকা এবং অ-বিবেচনার পরিচয় বহন করে। এই অবিবেচক অহমিকা হইতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতীয় সংসদে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হইয়া বড় বড় জ্ঞান দিয়া যান, হয়তো ‘শ্বেতাঙ্গ পুরুষের বোঝা’ বহনের শ্লাঘাও বোধ করেন। তাঁহারা ভাবেন না, বন্ধনী তাঁহাদেরও উপহার দেওয়া যায়। যুযুধান অস্ত্র প্রতিযোগিতা যদি নিন্দার যুগ্ম-লক্ষ্য হয়, তবে দশকের পর দশক ওয়াশিংটন-মস্কো কোন অচ্ছেদ্য হাইফেনে যুক্ত ছিল? আঞ্চলিক স্তরে এই সে দিন জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং উগো চাভেসের মধ্যবর্তী হাইফেনটি রাষ্ট্রপুঞ্জের মহতী সভাকেও যে ভাবে কলঙ্কিত করিয়াছে, ভারত-পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা অন্তত সাম্প্রতিক কালে তাহা করেন নাই। স্পষ্টতই, হাইফেন একটি আয়ুধ, যাহার সুযোগ আছে, সে ব্যবহার করে। সুইডিশ অ্যাকাডেমির সুযোগ ছিল।