একদা, সবে জেল থেকে বেরিয়েছি, মহাশ্বেতাদি আমাকে দিয়ে লেখানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। শেষমেশ বাধ্য হয়ে তাঁকে বলেছিলাম যে, সবাই যদি লেখে তবে করবেটা কে? আর আমরা যদি না করি, তবে আপনারা লিখবেন কী নিয়ে? ‘করা’ বলতে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বোঝাতে চেয়েছিলাম। এই ‘করা’টা যে কত জরুরি, যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলন তা নতুন করে দেখিয়ে দিল।
সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের হাল-হকিকত দেখে যখন মানুষজন হতাশ ও তিতিবিরক্ত, যখন বহিরাগত লুম্পেনরা রাজ্যের ছাত্র আন্দোলনের দখল নিয়েছে এবং তার ফলে শিক্ষায়তনে লুম্পেন বাহিনীর তাণ্ডবই ছাত্র আন্দোলনের তকমা পাচ্ছে, তখন এই মরা গাঙে নতুন জোয়ার এনে দিল যাদবপুর। যতই কুৎসা করা হোক, কোনও ক্রমে অস্বীকার করা যাবে না এই সত্য যে, যাদবপুরের কলরব আসলে নির্ভেজাল কলরব।
প্রত্যাশিত ভাবেই এই নিয়ে পণ্ডিতদের লেখালিখি চলছে। কঠোর শৃঙ্খলার নিগড়ে পরিসর ক্রমসংকীর্ণ করার বাস্তবকে এই কাগজেই চমৎকার ভাবে উন্মোচিত করেছেন গৌতম ভদ্র (৮-১০)। তাঁর স্থূলে ভুল নেই, কিন্তু ষাটের দশকে প্রেসিডেন্সি কলেজে ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার কিছু অসঙ্গতি আছে। গৌতম লিখেছেন, “১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যক্ষ সনৎ কুমার বসু সারা রাত ঘেরাও হন। শেষ রাতে পুলিশ এসে কাউকে বুঝিয়ে, কাউকে ধাক্কা দিয়ে, দু-এক জন আধ ঘণ্টার জন্য গ্রেফতার করে অধ্যাপক সনৎ বসুকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়।” ঘটনা হল, রাত দশটা নাগাদ পুলিশ কলেজ ঘিরে ফেলে, আমাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পুলিশি হামলার প্রতীকী প্রতিরোধের দায়িত্ব নিয়ে বেধড়ক মার খান কলেজ ইউনিয়ন সম্পাদক অমল সান্যাল এবং রাজ্য নেতা বিমান বসু। এক জনের কব্জি ভেঙে যায়, অন্য জনের মালাইচাকি সরে যায় লাঠির ঘায়ে, ৩৯ জন ছাত্র গ্রেফতার হন, জামিন পান সাত দিন পর, পর দিন থেকে পূজাবকাশ এগিয়ে এনে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কলেজ বন্ধের ঘোষণা হয়, সেই বন্ধ গেটের সামনে মাদুর পেতে আমরা লাগাতার অবস্থানে বসে পড়ি। প্রেসিডেন্সি কলেজ বন্ধ থাকে চার মাস ১৯৬৬ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ১৯৬৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত কলেজ বন্ধ থাকে প্রায় দেড় মাস কাল। যে সব ঘটনার অভিঘাতে পশ্চিমবঙ্গে পালাবদল ঘটে, সেখানে এই আন্দোলনের ভূমিকাকে কোনও ক্রমেই খাটো করা যাবে না। গৌতম প্রেসিডেন্সি কলেজে পুলিশি হামলার অন্য ছবি উপস্থাপিত করেছেন। তবে তাঁর মূল বক্তব্য সঠিক, তথ্যনিষ্ঠতার এ অভাব সেখানে তেমন ছায়াপাত করেনি।
কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। পণ্ডিতদের সমস্যা হল, মরজগতের বাস্তব আন্দোলনগুলিকে তত্ত্বের অমরলোকে উত্তীর্ণ করার কালে বক্তব্য এতই বিমূর্ত হয়ে ওঠে যে, আন্দোলনের রক্তমাংস তাতে ধরা পড়ে না, ছাত্রদের আশা-আকাঙ্ক্ষা আন্দোলনের জটিলতা ও তাৎপর্য সব কিছুই হারিয়ে যায়, অনেক কথার মাঝে আসল কথা অনুক্ত থেকে যায়। আজ যখন শাসক দলের প্রকৃত চেহারা চিনেও রেজিমেন্টেড পার্টির কেজো, কেঠো চেহারা থেকে মুখ ফিরিয়ে যাদবপুরের ছাত্ররা ঘোষণা করেছেন ‘আলিমুদ্দিন শুকিয়ে কাঠ, সামনে শত্রু কালীঘাট’, আর তাতে রাজ্যের মানুষজনের চাহিদার সম্যক অভিনন্দন ঘটেছে, তখন এই শব্দবন্ধকে বিচ্ছিন্ন ভাবে উল্লেখ করেও তার আসল তাৎপর্য পণ্ডিতদের লেখায় উন্মোচিত হতে পারেনি। কিন্তু শাসক দল তাতে ভয় পেয়েছে।
সেই ভয় এতটাই তীব্র হয়েছে যে এই আন্দোলনের আবেদনকে ভোঁতা করার জন্য শাসক উঠেপড়ে লেগেছে। গাঁজা-চরসের আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার কুৎসাকে গুরুত্ব না দিলে তাদের হাতিয়ার তিনটি। এক, বাড়াবাড়ির অভিযোগ। শাসকের বক্তব্য হল, ঘেরাও-অবরোধ ইত্যাদি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে চলে না, ছাত্ররা বাড়াবাড়ি করছেন। আসলে শুধু ছাত্র আন্দোলনই নয়, সমস্ত গণ-আন্দোলনেই এই ‘এক্সেস’ বা বাড়াবাড়ি নিহিত থাকে। কবে আর কোন আন্দোলনে আইন মেনে নিয়ম মেনে মেপেজুকে আন্দোলনের সীমানা নির্ধারণ করা যায়! ঘটনা হল, ইতিহাস আন্দোলনের ‘এক্সেস’ বিচার করে না, ‘এসেন্স’ বা মূল ভাবটাকে বিচার করে। আর সেই বিচারে ছাত্র আন্দোলনকে কোনও ক্রমেই নাকচ করা যায় না।
দুই, বহিরাগতদের উপস্থিতি নিয়ে অভিযোগ। চব্বিশ ঘণ্টার গণ-অনশনে ছাত্ররা এর জবাব দিয়েছেন ৫০৩ জন ছাত্র, যাদবপুরের ছাত্রছাত্রী এতে শামিল হন। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আমার নাম করে অভিযোগ করেছেন যে, পুলিশি নিগ্রহের সেই ভোরে আমি কেন যাদবপুরে হাজির হয়েছিলাম। এটা ঘটনা যে, রাত তিনটেয় পুলিশি নিগ্রহের খবর শুনে বিশ্বকর্মা পুজো সত্ত্বেও বহু কষ্ট করে গাড়ি জোগাড় করে আমি যাদবপুরে হাজির হই, কিন্তু তার দায় পার্থবাবুদেরই। যত দিন এই আন্দোলন ছাত্র ও উপাচার্যের সংঘাত হিসেবে যাদবপুরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ছিল, তত দিন আমরা কেউই যাদবপুরের ঘটনায় নাক গলাইনি। কিন্তু যখনই পুলিশ দিয়ে ছাত্রদের পেটানো হল, তখন থেকেই এই আন্দোলন আর শুধু যাদবপুরের ছাত্রদের আন্দোলন রইল না, হয়ে উঠল রাজ্যের ছাত্রসমাজের আন্দোলন, রাজ্যের সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষের আন্দোলন। পার্থবাবুরা শুনে রাখুন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপরে পুলিশি হামলা হলে তা তখন আর অভ্যন্তরীণ ব্যাপার থাকে না, সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষজন আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে দায়বদ্ধ, বহিরাগত তকমা দিয়ে তাঁদের আটকানো যাবে না।
তিন, যাদবপুরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যে হইচই শুরু হয়েছে, তার মর্মার্থ হল, কোনও ক্রমে যাদবপুরে নিয়মিত ক্লাস শুরু করে দিতে পারলেই যেন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে। ছাত্রীর যৌন হেনস্থার প্রকৃত তদন্তের জন্য ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত দাবি, পুলিশ দিয়ে ছাত্র পেটানো, ছাত্রদের ওপরে উপাচার্যের মিথ্যা দোষারোপ, পুলিশি ঘেরাটোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের অপপ্রয়াস, শিক্ষক সংগঠনের সংগঠনের ন্যায়সঙ্গত দাবি এ সবের যেন কোনও মূল্য নেই। বলা হচ্ছে, অবিলম্বে পঠনপাঠন শুরু না হলে ছাত্রদের ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ হয়ে যাবে! কিন্তু পুলিশি নজরদারিতে জেলখানা-সদৃশ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরে না। যাদবপুরের এক উজ্জ্বল গণতান্ত্রিক ইতিহাস রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীতে গণতান্ত্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাদবপুরের উন্মেষ। সেই গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য উপাচার্য ত্রিগুণা সেন থেকে শৌভিক ভট্টাচার্য পর্যন্ত সেই ঐতিহ্য সমানে পুষ্ট হয়েছে। আজ যদি ‘অপূরণীয় ক্ষতি’র দোহাই দিয়ে, গায়ের জোরে ছাত্রছাত্রী শিক্ষকদের তোয়াক্কা না করে নিয়মনিষ্ঠ পঠনপাঠন চালু করা হয়, তবে যাদবপুর আর যাদবপুর থাকবে না, তার ইতিহাস, ঐতিহ্যকে কবর দিতে হবে।
যে উপাচার্যের সিদ্ধান্তে ছাত্ররা পুলিশি নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, জোর করে তাঁকে ছাত্রছাত্রীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো যাবে না। পুলিশ দিয়ে ছাত্র পিটিয়ে অভিজিৎ চক্রবর্তী উপাচার্য পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন, এই সত্য শাসকরা যত তাড়াতাড়ি বোঝেন, ততই মঙ্গল। গায়ের জোরে ক্লাস চালু হলে ‘অপূরণীয় ক্ষতি’ ছাত্রছাত্রীদের মনুষ্যত্বের, যাদবপুরের ঐতিহ্যের অতঃপর যাদবপুর থেকে সজীব, প্রাণোচ্ছল, সৃষ্টিশীল ছাত্রছাত্রীর বদলে পাশ করে বের হবেন কেরিয়ারসর্বস্ব কুশিক্ষিত একদল মানুষ। আসলে শিক্ষায়তনে শেষ কথা বলার হকদার ছাত্রছাত্রীরাই। শিক্ষায়তনে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য জরুরি শিক্ষায়তনে গণতন্ত্র: ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি’ই ‘ক্যাম্পাস ডিসিপ্লিন’কে সুনিশ্চিত করতে পারে। ঘটনা হল, বর্তমান পরিস্থিতিতে যাদবপুরে ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ ফিরিয়ে আনার জন্য উপাচার্যের পদত্যাগের বিকল্প নেই। উপাচার্যেরসম্মানও এতেই রক্ষা হবে, আবার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের আত্মমর্যাদাও এই পথেই সুনিশ্চিত হবে, যাদবপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সুরক্ষিত হবে।
আর তা না করলে অপূরণীয় ক্ষতি হবে ছাত্র-মানসিকতা, আত্মমর্যাদা এবং মনুষ্যত্বের।