প্রশাসকের সাহস নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি বলিষ্ঠ নীতি রূপায়ণে তাঁহার সার্থকতা। বলিষ্ঠ নীতি সচরাচর অপ্রিয়। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম বছরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত, অপ্রিয় নীতির ভাণ্ডার এখনও সমৃদ্ধ নহে। যোজনা কমিশনের বদলে নীতি আয়োগ প্রতিষ্ঠা কিংবা সম্মার্জনী হস্তে স্বচ্ছ ভারত নির্মাণের সহিত আর যাহাই হোক, সাহসের কোনও সম্পর্ক নাই। বিমায় বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি বা জমি অধিগ্রহণের সংশোধিত বিধি স্বাগত, কিন্তু বলিষ্ঠতা দাবি করে না। যথার্থ সাহসের প্রমাণ দিতে চাহিলে সর্বাগ্রে সরকারি ব্যয় কমাইতে হইবে, সেই সকল ব্যয় যাহা জনমনোরঞ্জনের মুখ চাহিয়া বরাদ্দ হয়, যাহা উৎপাদনশীল নহে। যথা, রান্নার গ্যাস (এখনও), কেরোসিন, সারের দাম, রেলভাড়া ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে প্রদত্ত ভর্তুকি, যথা খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্পের যথেচ্ছ বিস্তারের খরচ, যথা কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা কর্মসূচিতে কোনও সম্পদ সৃষ্টি না করিয়া বিপুল অর্থব্যয়। তাহার পাশাপাশি শ্রম আইন সংস্কার, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ ইত্যাদি সিদ্ধান্তও আবশ্যক।
সনিয়া গাঁধী চালিত ইউপিএ’র দুই দফায় জনকল্যাণের নামে সরকারি ব্যয় প্রভূত মাত্রায় বাড়িয়াছে। অবিলম্বে তাহা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি, তাহা না হইলে সীমিত সম্পদ উৎপাদনশীল বিনিয়োগের কাজে নিয়োজিত হইবে না। কিন্তু এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ব্যয়সংকোচ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্বার্থে আঘাত করিবে, ফলে তাহা হইবে অপ্রিয় সিদ্ধান্ত। অসুস্থ মানুষকে তেতো ওষুধ সেবন করাইলে তাহার ভাল লাগে না, কিন্তু তাহার স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যই তাহা সেবন করাইতে হয়। ব্যয়সংকোচের অপ্রিয় সিদ্ধান্তগুলিও তেমনই অর্থনীতির স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য আবশ্যক। কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতি শাসকদের পিছনে জুজুর মতো ফিরিতে থাকে: এই বুঝি জনগণেশের মুখ ভার হয়, এই বুঝি ভোটের বৈতরণিতে ভাটার টান দেখা দেয়। নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী ভাষণ যত ডেসিবেলেই উঠুক, তিনি এখনও প্রমাণ করিতে পারেন নাই যে, তাঁহার জুজুর ভয় নাই। পারিবেন কি?
দিল্লি নির্বাচনের ফলাফলে প্রশ্নটি ঈষৎ ঘনীভূত। নিখরচায় জল, সস্তায় বিদ্যুৎ, দরিদ্রের বাসস্থান ইত্যাদি স্বপ্ন ফেরি করিয়া অরবিন্দ কেজরীবাল ক্ষমতায় আসিয়াছেন। স্বপ্ন পূরণ করিতে পারিবেন কি না, সংশয় আছে, কিন্তু জনগণেশকে খুশি করিবার প্রতিযোগিতাকে তিনি এক নূতন মাত্রা দিয়াছেন। অন্যান্য দলকে এই বাস্তবের মহড়া লইতে হইবে। আশঙ্কা সেখানেই: দিল্লির বিপর্যয়ে সন্ত্রস্ত হইয়া নরেন্দ্র মোদীও কি তবে জনপ্রিয়তার পথই ধরিবেন? তিনি সম্ভবত এই আশঙ্কা সম্বন্ধে সচেতন, সেই কারণেই প্রথমে অর্থমন্ত্রী এবং পরে তিনি নিজেও বলিয়াছেন, আর্থিক সংস্কারের নীতিতে তাঁহারা অবিচল থাকিবেন। অর্থমন্ত্রী জেটলির বক্তব্য: সংস্কারই দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথ এবং সেই উন্নয়নই দারিদ্র দূর করিবার সদুপায়। হক কথা। ইহাই প্রকৃত দীর্ঘমেয়াদি জনকল্যাণের পথ। সস্তা জনমনোরঞ্জনের সহিত তাহার মৌলিক প্রভেদ এখানেই যে, তাহার জন্য অনেক অপ্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হয়। তিক্ত ঔষধ সেবন করিলে যেমন স্বাস্থ্যের যথার্থ উন্নতি হয়, অপ্রিয় নীতি হজম করিলে তেমনই অর্থনীতির ভিত সুগঠিত হয়। দানসত্রে অভ্যস্ত ভোটদাতাদের সেই দাওয়াই পছন্দ হইবে না। ভবিষ্যতে তাঁহারা বুঝিবেন যে, দাওয়াই আবশ্যক ছিল, কিন্তু তাহা ভবিষ্যতের কথা। রাজনীতিকরা বর্তমান লইয়া ব্যতিব্যস্ত। অতএব কড়া দাওয়াই প্রয়োগের জন্য সাহস জরুরি। গ্রিসেও, ভারতেও। অরুণ জেটলি ও তাঁহার নেতাকে সেই সাহসের প্রমাণ দিতে হইবে। পক্ষকালের মধ্যে সাহসের পরীক্ষা। পরীক্ষার নাম: সাধারণ বাজেট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy