Advertisement
১৯ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

স্বখাতসলিল

ভ্লাদিমির পুতিনের প্রায়-একনায়কতন্ত্রের পক্ষে এত দিন একটি ইতিবাচক দাবি ছিল। তাঁহার শাসনকালের পূর্বে রাশিয়ায় যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করিত, তিনি তাহা দূর করিয়াছিলেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর আসিয়া সেই দাবিটিকে লইয়া গেল। রাশিয়ার অর্থনীতি শুধু যে ঘোর আতান্তরে পড়িয়াছে, তাহাই নহে; স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে, পুতিন এত দিন আন্তর্জাতিক বাজারের প্রসাদগুণকে নিজের বাহাদুরি হিসাবে চালাইতেছিলেন।

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

ভ্লাদিমির পুতিনের প্রায়-একনায়কতন্ত্রের পক্ষে এত দিন একটি ইতিবাচক দাবি ছিল। তাঁহার শাসনকালের পূর্বে রাশিয়ায় যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করিত, তিনি তাহা দূর করিয়াছিলেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর আসিয়া সেই দাবিটিকে লইয়া গেল। রাশিয়ার অর্থনীতি শুধু যে ঘোর আতান্তরে পড়িয়াছে, তাহাই নহে; স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে, পুতিন এত দিন আন্তর্জাতিক বাজারের প্রসাদগুণকে নিজের বাহাদুরি হিসাবে চালাইতেছিলেন। রাশিয়ার অর্থনীতি অধুনা মূলত ভূগর্ভস্থ পেট্রোলিয়ামের রফতানির উপর নির্ভরশীল। যত দিন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম চড়া ছিল, রাশিয়ার অর্থনীতির মূলধনী খাত উদ্বৃত্তে চলিতেছিল। গড়ে দৈনিক ষাট লক্ষ ব্যারেল তেল রফতানি করে রাশিয়া। গত ছয় মাসে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম একশো ডলার হইতে ষাট ডলারে নামিয়াছে। অর্থাত্‌, ছয় মাস পূর্বের তুলনায় এখন প্রতি দিন রাশিয়ার রফতানিজনিত আয় ২৪ কোটি ডলার কম। অর্থাত্‌, বত্‌সরে প্রায় ৯,০০০ কোটি ডলার। রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ আয়ের প্রায় সাড়ে চার শতাংশ। এই ধাক্কায় সে দেশের মুদ্রা রুবলের দাম হুহু করিয়া পড়িয়াছে। অবস্থা সামাল দিতে মঙ্গলবার রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হার ১০.৫ শতাংশ হইতে বাড়াইয়া ১৭ শতাংশ করিয়া দিল।

রাশিয়া একই সঙ্গে দুইটি ব্যাধিতে আক্রান্ত। প্রথমটির নাম ‘ডাচ ডিজিজ’। কোনও দেশ যদি মূলত প্রাকৃতিক সম্পদ রফতানির উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়ে, এবং সেই রফতানিকৃত পণ্যটির আন্তর্জাতিক বাজার চাঙ্গা থাকে, তখনই এই বিপদের সূত্রপাত। রাশিয়ারই যেমন। গত দশ বত্‌সর পেট্রোলিয়ামের বাজার ক্রমান্বয়ে চড়িয়াছে। তাহাতে রাশিয়া তেল বিক্রয় বাবদ মোটা আয় করিয়াছে। বাজারে রুবলের দামও বাড়িয়াছে। তাহার ফলে রাশিয়ার অন্য পণ্যগুলি, মূলত কলকারখানাজাত পণ্য, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় পিছু হঠিয়াছে, কারণ ডলারের অঙ্কে তাহার দাম অস্বাভাবিক রকম বেশি। আবার, রুবলের দাম বাড়িয়া থাকায় অর্থনীতি ক্রমে (অপেক্ষাকৃত সস্তা) আমদানির উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িয়াছে। এখন আচমকা তেলের দাম কমিয়া যাওয়ায় এই ছন্দটি সম্পূর্ণ ভাঙিয়া পড়িয়াছে। রফতানির টাকায় আর আমদানির খরচ মেটানো অসম্ভব।

রাশিয়ার দ্বিতীয় ব্যাধিটি এখানেই। এখন সে দেশ আন্তর্জাতিক বাজারের উপর যতখানি নির্ভরশীল, তাহা ভ্লাদিমির পুতিন বা তাঁহার পরামর্শদাতাদের পক্ষে অস্বস্তিকর। বিশেষত, রাশিয়ার মূলধনী খাতটি খোলা, অর্থাত্‌ সে দেশে আন্তর্জাতিক পুঁজির আসা-যাওয়ায় কোনও আগল নাই। বিদেশি ঋণের পরিমাণ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উত্‌পাদনের এক-তৃতীয়াংশ, এবং তাহার সিংহভাগ বেসরকারি ক্ষেত্রে। দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার এখনই বার্ষিক এক শতাংশের নীচে; তাহা দ্রুততর বেগে নিম্নগামী। ফলে, বিদেশি পুঁজির সবেগ দেশত্যাগ এখন মুহূর্তের অপেক্ষা। তাহা ঠেকাইতেই সুদের হার বাড়িয়াছে। কিন্তু, ১৭ শতাংশ সুদের হারে বিনিয়োগ প্রায় অকল্পনীয়। অর্থনীতির গতিভঙ্গই এখন ভবিতব্য। বাঁচাইতে পারিত আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের ন্যায় সংস্থা। কিন্তু পশ্চিম দুনিয়া এই মুহূর্তে রাশিয়ার উপর যে রকম খড়্গহস্ত, তাহাতে সেই সম্ভাবনাও অতি ক্ষীণ। রাশিয়া সর্বাঙ্গীণ বিপাকে পড়িয়াছে। শুধু তেলের জোরে দুনিয়ার মহাশক্তিগুলিকে চটাইয়া রাখা যে বিচক্ষণের কাজ হয় নাই, ক্রেমলিন প্রাসাদের অধীশ্বর সম্ভবত টের পাইতেছেন। তিনি পশ্চিম দুনিয়া এবং সৌদি আরবের বিরুদ্ধে তেলের দাম কম রাখিবার চক্রান্তের অভিযোগ তুলিয়াছেন। ইউক্রেন-ঘটিত পশ্চিমী নিষেধাজ্ঞা এবং তেলের বাজারে অভাবিত মূল্যহ্রাসের এই সমাপতন চক্রান্ত হোক বা না হোক, এই অভিজ্ঞতা হইতে তাঁহার শিক্ষা লইবার আছে। সদাচারের শিক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE