কেদারনাথ পুণ্যার্থীদের জন্য খুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। এক বছর আগের বিপর্যয়ে হাজার-হাজার পুণ্যার্থী ও পর্যটকের মর্মান্তিক পরিণতির স্মৃতি পিছনে ফেলিয়া চার ধাম-এর প্রধান ধাম কেদারনাথ পুনরায় দর্শনার্থীদের ভিড়ে কোলাহলমুখর। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত এই শিব-মন্দিরের দুর্গম পথে তীর্থযাত্রীদের আনাগোনা শুরু হইয়াছে। পুণ্যার্থীদের উৎসাহিত করিতে সরকারের তরফে নানা আকর্ষণীয় ছাড়ের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। লঙ্গরখানা খুলিয়া বিনা পয়সায় খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করা হইতেছে। রাত্রিবাসের জন্যও কোনও হোটেল-ভাড়া গনিতে হইতেছে না। অশক্ত ও মহিলা পুণ্যার্থীদের জন্য বিনা পয়সায় হেলিকপ্টার-যাত্রার বন্দোবস্তও রহিয়াছে। উত্তরাখণ্ড সরকার কেদারনাথ-সহ চার-ধাম যাত্রার হৃত মর্যাদা ও আকর্ষণ ফিরাইয়া আনিতে উন্মুখ।
কেদারনাথ দেশের পবিত্রতম তীর্থস্থানগুলির অন্যতম। প্রতি বছর ২৫ লক্ষ পুণ্যার্থী ও পর্যটক এখানে আসেন। গাড়োয়ালভূমির অর্থনীতি তাঁহাদের উপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল। হোটেল, দোকানপাট, ভাড়া-করা মোটরযান, ঘোড়া বা খচ্চরের মালিকরা সম্বৎসর তাকাইয়া থাকেন এই কয়েকটি মাসের দিকে, যখন বরফের চাদর সরাইয়া কেদারনাথ জাগ্রত হয়। গত বছর বিপর্যয়ের পর গাড়োয়ালের অর্থনীতি ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে তীর্থযাত্রা ও পর্যটন-নির্ভর পরিবারগুলি। কিন্তু যদি কেবল সেই বিবেচনা হইতেই তড়িঘড়ি কেদারনাথকে পুণ্যার্থীদের জন্য খুলিয়া দেওয়া হইয়া থাকে, তবে তাহা বিচক্ষণতার কাজ হয় নাই। বস্তুত, এই বিপর্যয়ের ঘটনা হইতে বরং কেদারনাথে তথা সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটন সম্পর্কে গভীর ভাবে বিচার-বিবেচনার প্রয়োজন ছিল। পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত ভিড় এবং তাঁহাদের উপভোগের জন্য এই ভঙ্গুর পার্বত্য প্রদেশে এলোপাথাড়ি গড়িয়া ওঠা হোটেল, দোকান ইত্যাদি গাড়োয়ালের প্রকৃতিতে যে ভারসাম্য বিনাশ করে, হড়পা বান ও কর্দম-ধসকে তাহারই পরিণতি রূপে পরিবেশবিদরা শনাক্ত করিয়াছেন। অপরিকল্পিত এবং অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণের ধকল তরুণ হিমালয় সহ্য করিতে পারে নাই। পর্যটনের স্বার্থে এই ভঙ্গুর পার্বত্য অঞ্চলের রুদ্ধশ্বাস বাণিজ্যিকীকরণ এখানকার পরিবেশের ভারসাম্য বিপর্যস্ত করিয়াছে। অতি যত্নে, সতর্কতার সহিত তাহা ফিরাইয়া আনা দরকার। কেদারনাথের পথ ও দরজা দ্রুত খুলিয়া দিতে গিয়া সরকার কি এই বিষয়টি উপেক্ষা করিতেছে না?
সত্য, প্রাথমিক পর্বে সরকার কিছুটা সাবধান। দিনে এক হাজারের বেশি তীর্থযাত্রীকে আপাতত কেদারগামী করা হইতেছে না। পুণ্যার্থীদের সংখ্যায় এই নিয়ন্ত্রণ কঠোর ভাবে জারি রাখা দরকার। এখনও অধিকাংশ পথই দুর্গম, আলগা পাথরখণ্ড এক পাশে সরাইয়া সংকীর্ণ পরিসর করিয়া দেওয়া হইয়াছে। চারিদিকে এখনও বরফের ঘন আস্তরণ থাকায় নির্মাণকাজ দ্রুত করা যাইতেছে না। যে কোনও সময় ধস নামিতে পারে, এমন শঙ্কা মাথায় লইয়াই চলিতে হইতেছে। যে-সড়ক দিয়া ঘুরপথে গাড়ি যাতায়াতের বন্দোবস্ত হইয়াছে, তাহাও সুনির্মিত নয়। পুণ্যার্থী জনতার ধর্মীয় আবেগ কিংবা তীর্থনির্ভর বৃত্তিজীবীদের অর্থনৈতিক উজ্জীবনের তাগিদকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়া অসতর্ক হইলে বিরাট অন্যায় হইবে। পুণ্যার্থীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ জরুরি। পরিবেশের স্বার্থে। তাঁহাদের আপন স্বার্থেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy