ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ দুই দিনের শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ১৩ মার্চের সফরের পটভূমি রচনা করিতে। হাজার হউক, দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীলঙ্কা সফরে যাইবেন। তিনি কেবল শ্রীলঙ্কার নেতৃবৃন্দের সহিত আলাপ-আলোচনাই করিবেন না, শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে ভাষণ দিবার বিরল সম্মানও তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে, নেহরু, ইন্দিরা ও মোরারজি দেশাইয়ের পর আর কেহ যাহা পান নাই। সর্বোপরি মোদীই হইবেন প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি কেবল কলম্বো নয়, সিংহলি বৌদ্ধদের সদর-দফতর অনুরাধাপুর, ক্যান্ডি এবং তামিলদের সাবেক ও বর্তমান রাজধানী জাফ্নাও সফর করিবেন। এমন ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ সফরের জন্য কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় বইকী! সুষমার সফরের সেটাই কারণ। আর তাঁহার কলম্বো পদার্পণের কয়েক ঘণ্টা আগেই শ্রীলঙ্কা সরকারের তরফে কলম্বোয় প্রস্তাবিত ১৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের চিনা আবাসন প্রকল্প স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হইল। কলম্বোয় ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপাল সিরিসেনার সরকার এই সিদ্ধান্ত মারফত একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিয়া রাখিলেন।
বার্তাটি হইল, পূর্বসূরি মহিন্দা রাজাপক্ষের মতো তিনি ভারতের প্রতি বিমুখ থাকিয়া চিনকে সমাদর করিতে তৎপর হইবেন না। রাজাপক্ষের আমলে হাম্বানটোটা বন্দর নির্মাণের বরাত পাইয়া চিন শত শত কোটি ডলার লগ্নি করে। বিনিময়ে শ্রীলঙ্কার বন্দর ও নৌঘাঁটিগুলিতে চিনা সাবমেরিন ও নৌবহর নোঙর করার এবং বেজিং পরিকল্পিত ‘সিল্ক জলপথ’-এর একটি স্টেশন হিসাবে কলম্বো তথা শ্রীলঙ্কাকে ব্যবহার করার অধিকারও অর্জন করিয়া লয়। ভারতের আপত্তি অগ্রাহ্য করিয়া রাজাপক্ষের সরকার চিনা পরমাণু সাবমেরিনকে বন্দরে ভিড়িতে দিয়াছে। মৈত্রীপাল সিরিসেনা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইয়াই বেজিংয়ের পরিবর্তে নয়াদিল্লির প্রতি পক্ষপাত স্পষ্ট করিয়া দেন। তাঁহার বিদেশ সফর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল ভারতের নাম। সেই সফর ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনে সমর্থ হইয়াছে। এই সহযোগিতাকেই আরও প্রসারিত ও বহুমুখী করিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীও কলম্বো সফরের প্রস্তুতি লইতেছেন। এমন সময়ে কলম্বোয় চিনা আবাসন প্রকল্প স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়া সিরিসেনা জানাইয়া দিলেন, নিকটতম প্রতিবেশীর সহিত নিজের নিয়তিকে বাঁধিয়া লইতেই তিনি অধিকতর আগ্রহী।
ভারতের পক্ষে ইহা অবশ্যই সুসমাচার। নয়াদিল্লি কলম্বোকে পরমাণু জ্বালানি তৈয়ারির প্রযুক্তি ও সহযোগিতাও সরবরাহ করিতে চুক্তিবদ্ধ। দুই দেশেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন দ্রুত তাহাদের অগ্রাধিকারেও বদল আনিয়াছে। ফলে ভারত মহাসাগরে অবিসংবাদী নৌশক্তি হইয়া উঠিতে ভারতকে সমুদ্রপথে ঘিরিয়া ‘মেরিন সিল্ক রুট’ গড়ার যে প্রকল্পে চিন ইতিমধ্যেই ৪ হাজার কোটি ডলার বরাদ্দ করিয়াছে, অন্তত কলম্বো বা হাম্বানটোটায় নৌ-ঘাঁটি বানাইয়া তাহা সম্পূর্ণ করার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় তাহাতে আপাতত একটা ধাক্কা লাগিল। সত্য, শ্রীলঙ্কা চিনা প্রকল্পটি এখনও বাতিল করে নাই, পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণ দেখাইয়া স্থগিত করিয়াছে মাত্র। কিন্তু কলম্বোর বার্তাটি পড়িয়া লইতে নয়াদিল্লি বা বেজিং কাহারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।