Advertisement
E-Paper

সর্বনাশের আগে

মনুস্মৃতিতে ন্যায়বিচারের গুণকীর্তনস্বরূপ বলা হইয়াছে: ন্যায়কে রক্ষা করিলে তাহা রক্ষা করে, ন্যায়কে লঙ্ঘন করিলে তাহা ধ্বংস করে। যে কোনও যুগে যে কোনও দেশে রাজধর্মের ইহা অন্যতম মূল নীতি।

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১

মনুস্মৃতিতে ন্যায়বিচারের গুণকীর্তনস্বরূপ বলা হইয়াছে: ন্যায়কে রক্ষা করিলে তাহা রক্ষা করে, ন্যায়কে লঙ্ঘন করিলে তাহা ধ্বংস করে। যে কোনও যুগে যে কোনও দেশে রাজধর্মের ইহা অন্যতম মূল নীতি। রাজশক্তি এক বার নয়, দুই বার নয়, ক্রমাগত ন্যায়ের শর্ত লঙ্ঘন করিয়া চলিলে তাহা যে সেই শক্তির অধিকারীদেরও ক্রমে ধ্বংসের পথে লইয়া যায়, পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা সম্ভবত তাহা ক্রমশ টের পাইতেছেন। তাঁহাদের হম্বিতম্বি ঈষৎ কমিয়াছে, তাঁহাদের কথাবার্তায় বেপরোয়া এবং দুর্বিনীত ভাবটিও হয়তো কিঞ্চিৎ স্তিমিত হইয়াছে। কিন্তু সেই বোধ তাঁহাদের আচরণে এখনও কোনও লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটাইয়াছে, এমন কথা বলা শক্ত। এখনও আপন ভুল এবং অন্যায় স্বীকার করিবার কোনও সুবুদ্ধি রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ আসন হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন স্তরের কর্ণধারদের কথায় ও কাজে দেখা যায় নাই। এখনও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের তদন্তে অসহযোগিতা এবং প্রকারান্তরে বাধাসৃষ্টি অব্যাহত রহিয়াছে। এখনও মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে সামান্য তির্যক মন্তব্যের শাস্তিতে হাজতবাস চলিতেছে। এখনও শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হইলে গুরুপাপে লঘুদণ্ড এবং না হইলে লঘুপাপে গুরুদণ্ড বিহিত হইতেছে। পশ্চিমবঙ্গে ফলিত রাজধর্মের মূল নীতি দাঁড়াইয়াছে: শিষ্টের দমন এবং দুষ্টের পালন।

মনুস্মৃতির কালে গণতন্ত্র ছিল না। গণতন্ত্রের কালে রাজা আসে যায়, প্রশাসন নিরবচ্ছিন্ন। এক সরকারের স্থানে আর এক সরকার অধিষ্ঠিত হয়, রাষ্ট্রযন্ত্র বহাল থাকে। বহাল থাকেন আমলাবাহিনী, বহাল থাকেন পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা। সরকার বদলাইলে ব্যক্তিগত ভাবে তাঁহাদের অনেকের হয়তো আসন বদলায়, কিন্তু ব্যক্তি গৌণ, ব্যবস্থা মুখ্য। এখানেই গণতন্ত্রে রাজধর্ম লঙ্ঘনের বৃহত্তর এবং গভীরতর বিপদ। এক সরকার রাজধর্ম লঙ্ঘন করিলে শাসনযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দুর্বল হয়, সরকার বদলাইলেও সেই ক্ষতির কুফল থাকিয়া যায়। এই কারণেই মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুদায়িত্ব ছিল বামফ্রন্ট জমানার সঞ্চিত বিষ প্রবল উদ্যমে নিষ্কাশন করা। পুলিশ এবং প্রশাসনের উপর দলতন্ত্রের কুপ্রভাব দীর্ঘ দিন ধরিয়া তাহাকে দুর্বল করিয়াছিল, সেই দুর্বলতা ঘুচাইয়া তাহাকে আবার সুদৃঢ় এবং নিরপেক্ষ একটি শাসনযন্ত্রে পরিণত করা। তিনি তাহা করেন নাই। তাহার পরিবর্তে পুলিশ প্রশাসনকে আরও নিবিড় ভাবে দলের বশীভূত করিয়াছেন, বস্তুত তাহাকে কার্যত ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের রক্ষী বাহিনীতে পরিণত করিয়াছেন। বামফ্রন্ট প্রশাসনের মেরুদণ্ড নরম করিয়া রাখিয়াছিল, তৃণমূল কংগ্রেস তাহা ভাঙিয়া দিয়াছে। ইহা দুঃশাসনের এক অভূতপূর্ব রূপ।

প্রথমে সারদা কাণ্ডের তদন্তে সিবিআই এবং তাহার পরে বর্ধমান কাণ্ডের তদন্তে এনআইএ দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে যে ভাবে ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনের পালা শুরু হইয়াছে এবং তাহার ফলে পূর্ববর্তী তদন্তের ভারপ্রাপ্ত রাজ্য পুলিশের যে যুগপৎ করুণ এবং ভয়াবহ মূর্তি উন্মোচিত হইতেছে, তাহা ওই দুঃশাসনেরই পরিণাম। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা যাহা পারেন, রাজ্য পুলিশ ও গোয়েন্দারা তাহা কেন পারেন না? তাঁহারা অক্ষম, অথবা অনিচ্ছুক, অথবা দুইই। অনিচ্ছার কারণ অনুমান করা কঠিন নহে। নীচের তলায় পুলিশের সহিত দুষ্কৃতী বা তাহাদের পৃষ্ঠপোষকদের যোগাযোগের অভিযোগ উড়াইয়া দেওয়ার নয়, কিন্তু উত্তরোত্তর এই সংশয় গভীরতর যে, উপরমহল হইতে যথেষ্ট তৎপরতার সহিত তদন্ত না করিবার, এমনকী যথেষ্ট তৎপরতার সহিত তদন্তে বাধা দেওয়ার মন্ত্রণা অথবা নির্দেশ ছিল। এই সংশয় কোথায় কত শতাংশ সত্য, তাহা হয়তো ভবিষ্যতে জানা যাইবে। কিন্তু সংশয় যে প্রবল, তাহাই একটি রাজ্যের পক্ষে সর্বনাশের সূচক। সেই সর্বনাশের বোধ রাজ্যের শাসকদের আছে বলিয়া ভরসা হয় না। হয়তো থাকিবার কথাও নহে। সর্বনাশের আগে বুদ্ধিনাশ হইয়া থাকে।

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy