আগাথা ক্রিস্ট্রি হোক বা শার্লক হোমস কিংবা হ্যারি পটার— বিদেশি সাহিত্যের প্রায় সমস্ত জনপ্রিয় চরিত্রই অনুবাদের হাত ধরেছে কখনও না কখনও। বাংলা সাহিত্যের স্মরণীয় চরিত্রেরাও একই ভাবে বিশ্বের দরবারে সমাদর পেয়েছে অনুবাদের জাদুকাঠির ছোঁয়াতেই। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ নোবেল পুরস্কার এনেছে সেই অনুবাদের হাত ধরেই। তবে শুধু সাহিত্য নয়। সৃজনের ঘর পেরিয়ে রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ করা বই। অথচ এই অনুবাদকেরা বেশিরভাগ সময়ই থেকে জন অন্তরালে।
অধ্যাপক অভীক মজুমদারের কথায়, “অনুবাদের কাজ নিয়ে পড়ুয়ারা যথেষ্ট আগ্রহী। শেখার ইচ্ছে রয়েছে, কিন্ত বাংলার যে সমস্ত শিল্পী, সাহিত্যিকেরা অনুবাদের পথ দেখিয়েছিলেন বা এখনও সেই কাজ যাঁরা করে চলেছেন— তাঁদের কথা এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানেনই না।”
অনূদিত শব্দচয়নের কলা কৌশল শেখাতে পাঁচ দিনের বিশেষ উৎসব-এর আয়োজন করেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের সেন্টার ফর ট্রান্সলেশন অফ ইন্ডিয়ান লিটারেচার (সেন্টিল)। চলতি বছরই এই কেন্দ্রের ২০তম বর্ষপূর্তি। সেখানেই উঠে এল অনুবাদের একাল সেকাল নিয়ে নানা কথা। আশাবাদী অভীক মজুমদার। তিনি মনে করেন, নিয়মিত অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে চর্চা, কর্মশালা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অজ্ঞতা দূর করা যেতে পারে। সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
এ প্রসঙ্গে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক সায়ন্তন দাশগুপ্ত বলেন, “অনুবাদ চর্চায় ভারতীয় ভাষা নিয়ে কাজের সুযোগ রয়েছে যথেষ্ট। আগ্রহী পড়ুয়াদের অনুবাদ কৌশল শেখাতেই এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে, যাতে তাঁরা অনুবাদ নিয়ে আরও জানার সুযোগ পান।”
কলকাতার সরকারি এবং বেসরকারি কলেজের পড়ুয়ারা এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। নিজস্ব চিত্র।
পাঁচ দিনের এই কর্মশালায় যোগ দিয়েছিল— বাসন্তীদেবী কলেজ, গুরুদাস কলেজ, রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক কলেজের পাশাপাশি অ্যমিটি ইউনিভার্সিটি-র মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারাও। স্নাতক থেকে শুরু স্নাতকোত্তর স্তরের পড়ুয়া এবং গবেষকদের ছ’টি দলে ভাগ করে নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের ‘মেন্টর’ হিসাবে বাংলা, ইংরেজি, নেপালি, খাসি, উর্দু ভাষায় অনুবাদ করার প্রাথমিক পর্বের প্রশিক্ষণ দেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের অধ্যাপকেরা, যাঁরা অনুবাদ নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়ের লেখনী থেকে পড়ুয়ারা অনুবাদ করতে গিয়ে ভাষার মার্ধুয বা বিষয়বস্তুর প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছেন কখনও কখনও। সেই সমস্যার সমাধান কী ভাবে সম্ভব, তা নিয়েও কর্মশালায় বিশদ আলোচনা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক সুচরিতা চট্টোপাধ্যায় এবং ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক নিশী পুলুগুর্থ।
এমন কাজের অভিজ্ঞতা অনেক অধ্যাপকের কাছেও প্রথম। বাসন্তীদেবী কলেজের কমিউনিকেটিভ ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায় তেমনই একজন। তিনি বলেন, “পড়ুয়াদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নতুন ভাবনা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছি। এমন অনেক প্রশ্নই মনে জেগেছে, যা একা বসে অনুবাদের ক্ষেত্রে মাথায় আসেইনি। তাই ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরও কাজ করার ইচ্ছে রইল।”
কর্মশালার শেষ দিনে অধ্যাপকেরা নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন। নিজস্ব চিত্র।
নেপালি ভাষা নিয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে গবেষণামূলক কাজ করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজ় বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শ্রদ্ধাঞ্জলী তামাং এবং গুরুদাস কলেজের শিক্ষিকা ভাবনা থিঙ তামাং। এই চারদিনের কর্মশালায় তাঁরা পড়ুয়াদের নেপালি ভাষা, তার উচ্চারণ, এমনকি লিপির ক্ষেত্রে দেবনাগরী হরফের কতটা সামঞ্জস্য রয়েছে— তা শেখানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁরা আশাবাদী, বাংলা ভাষায় অনুবাদের মধ্যে দিয়ে সার্বিক ভাবে নেপালি ভাষায় চর্চা বৃদ্ধি পাবে।