আইএস জঙ্গিদের অগ্রগতি ঠেকাতে ব্যস্ত ইরাকি সেনা। ছবি: এএফপি।
শিয়া জোটের মনোনীত হায়দার আল-আবাদিকেই ইরাকে সরকার গড়ার আহ্বান জানালেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট ফৌদ মাসুম। এর আগে প্রেসিডেন্ট মাসুম কার্যনির্বাহী প্রধানমন্ত্রী নূর-মালিকিকে সরে দাঁড়াতে বলে ছিলেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী পদের দাবি ছাড়তে নারাজ ছিলেন নূর আল-মালিকি। ইরাকের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ফৌদ মাসুমের আবেদন অগ্রাহ্য করে তিনি তৃতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী পদের দাবি জানাবেন বলে স্থির করেন। মালিকির এই ইচ্ছেয় ইরাকের সবোর্চ্চ আদালতের শীলমোহর পড়েছে বলে ইরাকের সরকারি টেলিভিশন এবং রেডিওতে প্রচারও করা হয়। যদিও সর্বচ্চো আদালতের তরফে জানান হয়েছে, প্রেসিডেন্টকে শুধু পার্লামেন্টের সবচেয়ে বড় জোটের প্রার্থীকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিতে বলা হয়েছে। সেই নির্দেশ মেনেই প্রেসিডেন্ট ফৌদ মাসুম শিয়াদলগুলির জোটের প্রার্থী হায়দার আল-আবাদি কে আহ্বান জানান।
কিন্তু মালিকি এই ঘোষণা মানবেন কি না তা জানা যায়নি। প্রেসিডেন্টের আবেদন অগ্রাহ্য করে মালিকি উন্টে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক আদালতে অভিযোগ জানানোর সিদ্ধান্ত নেনে। তাঁর অভিযোগ ছিল, প্রেসিডেন্ট গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে মদত দিচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট ফৌদ ইচ্ছে করেই প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন জমা দেবার সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে মালিকির অভিযোগ।একই সঙ্গে বাগদাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে মালিকির অনুগত ইরাকি স্পেশাল ফোর্সকে মোতায়েন করা হয়। এর ফলে এক দিকে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর জঙ্গিদের উত্তরে অভিযান, অন্য দিকে মালিকির অবস্থান— দুইয়ে মিলে ইরাকের পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। রবিবার সন্ধ্যায় ইরাকের কার্যনির্বাহী প্রধানমন্ত্রী মালিকি ফের ওই পদের জন্য নির্বাচনে দাঁড়াবেন বলে ঘোষণা করেন।কিন্তু মালিকির অস্বস্তি বাড়িয়ে শিয়াদলগুলির জোট প্রধানমন্ত্রী পদে লড়াইয়ের জন্য হায়দার আল-আবাদি কে বেছে নেয়।
আল আবাদি
এই বছরের এপ্রিলে সাধারণ নির্বাচনে মালিকির শিয়া দল সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে সরকার গঠনের জন্য অন্য দলের সাহায্য প্রয়োজন হয়। কিন্তু গত দশ বছর ধরে চলা মালিকি-সরকারের বিদ্বেষমূলক নীতির কারণে কোনও সুন্নি বা কুর্দ রাজনৈতিক দল তাঁকে সর্মথন করতে রাজি হয়নি। অনেকের মতে মালিকির শিয়া ঘেঁষা নীতির কারনেই আজ আইএস জঙ্গিদের এত বাড়বাড়ন্ত। ফলে সরকার গঠন এখনও সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে কয়েক বার ইরাকি পার্লামেন্টের অধিবেশন বসলেও কোনও ঐকমত্যে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি। কুর্দ ও সুন্নি দলগুলি বার বার মালিকির অপসারণের দাবিতে সুর চড়িয়েছে। দেশের বাইরে থেকেও (বিশেষ করে আমেরিকা ও কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ) সর্বদল সরকার গঠনের স্বার্থে মালিকিকে সরে যেতে অনুরোধ করে। অনুরোধ করেন ইরাকে শিয়াদের প্রধান ধর্মগুরু আলি সিস্তানিও। কিন্তু মালিকিকে টলানো যায়নি।
এর মধ্যেই সিরিয়া থেকে এসে সুন্নি আইএস জঙ্গিরা উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। তাদের হাতে তাসের ঘরের মতো একের পর এক শহরের পতন শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ইরাকি সেনা তাদের অগ্রগতি আটকাতে পারলেও দেশের বিশাল অংশ জুড়ে আইএস ‘ইসলামিক স্টেট’-এর ঘোষণা করে। আবু বকর আল-বাগদাদিকে খলিফা বলেও ঘোষণা করে তারা। সম্প্রতি তারা উত্তর দিকে কুর্দশাসিত অঞ্চলের দিকে অভিযান শুরু করেছে। এই অবস্থায় আইএস-কে মোকাবিলার জন্য সর্বদল সরকারের দাবি ওঠে। কিন্তু মালিকি তা পত্রপাঠ খারিজ করে দেন। প্রেসিডেন্টের আবেদনেও মালিকি অনড় থাকায় তাঁর প্রবল সমালোচনা করেছে আমেরিকা। সমালোচনা করেছেন ফ্রান্সের বিদেশমন্ত্রী লরেন্ট ফাবিয়াসও। রবিবার তিনি বাগদাদে ছিলেন।
মালিকির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বাগদাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলির দখল নিয়ে নেয় তাঁর অনুগত ইরাকি স্পেশ্যাল ফোর্স। বাগাদাদের গ্রিন জোন-এর (এখানে আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও ইরাকি সরকারের গুরত্বপূর্ণ দফতরগুলি আছে) প্রবেশ পথে ট্যাঙ্ক মোতায়েন কর হয়। অন্য দিকে, মার্কিন বিমান হানার সহায়তায় কুর্দ পেশমেরগা যোদ্ধারা আরবিলের দক্ষিণ পশ্চিমে নিনেভে প্রদেশের নুওইর ও মাখমুর শহর দু’টি পুনরুদ্ধার করেছে। নিরাপত্তার স্বার্থে আরবিলের মার্কিন কনস্যুলেট থেকে বেশ কিছু কর্মী সরিয়ে নিচ্ছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট। রবিবার কুর্দ স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি আইএস জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য আরও অস্ত্র সাহায্যের আবেদন করেছেন।
পাশাপাশি মার্কিন বিমান আক্রমণও চলছে। রবিবার আরবিলের কাছে আইএস জঙ্গিদের একটি কনভয়ের উপরে মার্কিন বিমান হামলা চালায়। কিন্তু আরবিলের দিকে এগোতে না পারলেও এই অঞ্চলে আরও একটি তৈলক্ষেত্র আইএস জঙ্গিদের দখলে এসেছে। এর ফলে তাদের অস্ত্র ও রসদ সংগ্রহ করা সহজ হবে। চলছে ত্রাণের কাজও। রবিবার রাতে চতুর্থ বার ত্রাণসামগ্রী ফেলে মার্কিন ও ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ার ফোর্স (র্যাফ)-এর বিমান। পেন্টাগন সূত্রে খবর, রবিবার রাতে ৭৪ হাজার মিলিটারি রেশনের প্যাকেট ও মোট ১৫ হাজার গ্যালন জলের প্যাকেট সিনজার পর্বতে আটকে থাকা ইয়াজিদিদের জন্য ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ সূত্রে খবর, ৩০ হাজার ইয়াজিদি প্রাণ নিয়ে কুর্দ শাসিত অঞ্চলে যেতে পেরেছেন। অন্য দিকে, ইয়াজিদিদের উপরে আইএস জঙ্গিদের হামলার নানা খবর সামনে আসতে শুরু করেছে। পালানোর সময়ে প্রায় ৫০০ জন ইয়াজিদিকে হত্যা করে কবর দেওয়ার পাশাপাশি আরও ৫০০ জন ইয়াজিদি মহিলাকে বন্দি করে আইএস জঙ্গিরা নানা অত্যাচার চালাচ্ছে বলে খবর। সিনজার পর্বতের দক্ষিণে আটকে থাকা ইয়াজিদিদের এখনও কোনও সুরাহা হয়নি। এই ইয়াজিদিদের ধর্ম পরিবর্তন করার জন্য রবিবার রাত পর্যন্ত সময় দিয়েছিল আইএস জঙ্গিরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy