তেলঙ্গানায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হল বিজেপি এবং কংগ্রেসের মধ্যে। আসনসংখ্যার নিরিখে কখনও এগিয়েছে বিজেপি, আবার কখনও কংগ্রেস। তবে শেষ ‘রাউন্ডে’ দু’দলই সমান-সমান আসন জিতল তেলঙ্গানায়। অন্য দিকে, কলভাকুন্তলা চন্দ্রশেখর রাওয়ের (‘কেসিআর’ নামেই যিনি জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত) দল ভারত রাষ্ট্র সমিতির (বিআরএস) অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে।
ভোটের ফলাফলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তেলঙ্গানায় কংগ্রেস জিতেছে আটটি আসনে। বিজেপিও পেয়েছে সমান সংখ্যক আসন। তবে ভোট শতাংশের হিসাবে কংগ্রেসের থেকে পিছিয়েই থাকল বিজেপি। কংগ্রেস এই রাজ্যে ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। সেখানে বিজেপি প্রায় ৫ শতাংশ কম ভোট পেল। কিন্তু খাতা খুলতে পারল না বিআরএস। নয় থেকে একেবারে শূন্যে নেমে গেল তারা। অন্য দিকে, হায়দরাবাদের আসনটি নিজের দখলেই রাখলেন ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম)-এর প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি।
আরও পড়ুন:
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তেলঙ্গানার ১৭টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৯টিই ছিল বিআরএস-এর দখলে। বিজেপি জিতেছিল চারটি আসন এবং কংগ্রেসের দখলে ছিল মাত্র তিনটি। হায়দরাবাদ লোকসভা আসন থেকে লড়ে জিতেছিলেন প্রধান ওয়েইসি।
ভোট শতাংশের হারে ২০১৯ সালে কংগ্রেস এবং বিজেপির থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিল বিআরএস। পরিসংখ্যান বলছে, সে বার তেলঙ্গানার ১৭টি আসনে গড় ভোটদানের হার ছিল ৬২.৭৭ শতাংশ। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল বিআরএস— ৪১.২৯ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে ছিল কংগ্রেস। তাদের পক্ষে ভোট পড়েছিল ২৯.৪৮ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে থাকা বিজেপি পেয়েছিল ১৯.৪৫ শতাংশ ভোট। মাত্র ২.৭৮ শতাংশ ভোট পায় ওয়েইসির দল। পাঁচ বছর পর এ বারের লোকসভা নির্বাচনে তেলঙ্গানার ১৭টি আসনে গড় ভোটদানের হার ছিল ৬৬.৩ শতাংশ। গত বারের তুলনায় প্রায় ৪ শতাংশ বেশি।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তবে গত পাঁচ বছরে তেলঙ্গানার রাজনীতিতে অনেক বদল এসেছে। বিআরএস প্রধান কলভাকুন্তলা চন্দ্রশেখর রাও (‘কেসিআর’ নামেই যিনি জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত) শাসকের গদিচ্যুত হয়েছেন। ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পালাবদলের পর থেকেই তেলঙ্গানাতে জমি হারাতে শুরু করেছেন তিনি। সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে জেতার থেকেও রাজনীতিতে ভেসে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বিআরএসের কাছে। গত ১৩ মে চতুর্থ দফায় তেলঙ্গানার ১৭টি লোকসভা আসনের সব ক’টিতেই ভোটগ্রহণ হয়। এ বারের লড়াই ছিল মূলত ত্রিমুখী— কংগ্রেস, বিআরএস এবং বিজেপির মধ্যে।
পর পর দু’বার রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পরে ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হ্যাটট্রিকের লক্ষ্যে নেমেছিল বিআরএস। কিন্তু কেসিআর নিজে হেরেছেন। তার পরে ধীরে ধীরে দল ভাঙতে শুরু করে। পরিসংখ্যান বলছে, পাঁচ বছর আগে যে ৯ জন সাংসদ তেলঙ্গানায় বিআরএএস-এর টিকিটে জিতেছিলেন, তাঁদের মধ্যে পাঁচ জনই কেসিআরকে ছেড়ে কংগ্রেস-বিজেপির টিকিটে লোকসভার যুদ্ধে নেমেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, আবগারি মামলায় কেসিআর কন্যা কে কবিতার নাম জড়িয়ে যাওয়া এবং তাঁর গ্রেফতারি বিআরএসকে আরও কোণঠাসা করে দিয়েছিল।
দলের অন্দরেই শুরু হয় ‘ছাড়ো ছাড়ো’ রব। সে দিক থেকে রাজ্য রাজনীতিতে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য লোকসভা নির্বাচনই ছিল বড় মঞ্চ। তবে সেখানে আশানরূপ ফল করতে পারল না। তেলঙ্গনা থেকে প্রায় মুছে গেল বিআরএস। এ বার একটা আসনও জিততে পারল না কেসিআরের দল।
আরও পড়ুন:
২০২৩ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই কেসিআরের দল ভাঙতে নেমে পড়েছিল কংগ্রেস। দলের ছোট-বড় একাধিক নেতা শিবির বদলেছেন। কেসিআরের দল যত ভেঙেছে, ততই তেলঙ্গানায় কংগ্রেসের ‘হাত’ শক্ত হয়েছে। শুধু কংগ্রেস, নয় বিজেপিও তেলঙ্গনাতে পদ্ম ফোটাতে শুরু করেছে। বিজেপির একাংশের দাবি ছিল, উত্তর ভারতে যদি ঘাটতি হয়, তা হলে তা দক্ষিণ ভারত দিয়ে মেটাবে পদ্মশিবির। ভোটপ্রচারেও সেই ইঙ্গিত দিয়েছিল বিজেপি। দক্ষিণের রাজ্যগুলির মধ্যে জোর দেওয়া হয়েছিল তেলঙ্গানাতে। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের মত শীর্ষনেতারা বার বার ছুটে গিয়েছেন প্রচারে। জনসভা থেকে রোড-শো— বাদ পড়েনি কিছুই। ভোটের ফল থেকে স্পষ্ট, সেই ম্যাজিক কাজ করল তেলঙ্গানায়। কংগ্রেসের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করল বিজেপি। তবে হায়দরাবাদে ওয়েইসির নিরঙ্কুশ আধিপত্য খর্ব করতে বিজেপি এ বার প্রার্থী করেছিল মাধবীলতাকে। কিন্তু সেই আশাপূরণ হল না পদ্মশিবিরের। মাধবীকে তিন লক্ষেরও বেশি ভোটে হারালেন ওয়েইসি।
অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে স্বাধীন রাজ্য হওয়ার পর দ্বিতীয় বার তেলঙ্গানায় লোকসভা নির্বাচন হল। তেলঙ্গানার স্বাধীন রাজ্যের দাবি অনেক দিনের। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল তেলঙ্গানাবাসীর। ওই মাসে সংসদে অখণ্ড অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে নয়া রাজ্য গড়ার বিল পাস করেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সরকার। ২০১৪ সালের ২ জুন ‘নতুন রাজ্য’ হিসাবে ভারতের মানচিত্রে স্থান পায় তেলঙ্গানা।
পৃথক রাজ্য তৈরিতে কংগ্রেসনেত্রী সনিয়া গান্ধীরও ‘ব্যক্তিগত উদ্যোগ’ ছিল। তবে পৃথক রাজ্যের দাবিতে কেসিআরের দলের আন্দোলনের কথাও ভোলার নয়। বছরের পর বছর ধারাবাহিক ভাবে আন্দোলন চালিয়েছিলেন কেসিআর। পৃথক রাজ্য হওয়ার পর তেলঙ্গানার চালকের আসনে ছিল বিআরএস-ই। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বড় জয় পান কেসিআর। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য-রাজনীতির দাবার বোর্ডে কংগ্রেস-বিজেপির চালে মাত হয়েছেন তিনি। এমনই অবস্থা যে, গত কুড়ি বছরে এই প্রথম নিজের পরিবারের কাউকে লোকসভা নির্বাচনে টিকিট দিতে পারেননি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কেসিআর! রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে স্পষ্ট রাজ্য রাজনীতিতে তাদের অস্তিত্ব চরম সঙ্কটের মুখে পড়ল। এখন দেখার কী ভাবে এই ধাক্কা সামাল দেন কেসিআর।