E-Paper

‘যাকে পারেন জেতান স্যর, আমি আর পারছি না’

রাজ্যের বহু ভোটযুদ্ধের সাক্ষী,শীর্ষ স্তরের এক আমলা বলছেন, “দেশের ভোটব্যবস্থায় টি এন শেষনের অবদানের এও এক নমুনা। এ ভাবে গুনতে সময় লাগত অনেক বেশি।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২৪ ০৬:১১

—প্রতীকী ছবি।

ভবিষ্যতের প্রথম সারির তৃণমূল নেতা, তখন দলীয় প্রার্থীর পুঁচকে এজেন্ট তিনি। গণনাকেন্দ্রে সংশ্লিষ্ট আমলাদের কাছে প্রায় কেঁদে পড়েছিলেন। “স্যর যাকে পারেন জেতান। বাটখারা দিয়ে ওজন করে মেপে দেন। এ দিকে সাত গ্রাম, ও দিকে পাঁচ গ্রাম। যা মনে হয় করুন। যাকে পারেন জেতান…আমি আর পারছি না!”

১৯৯৬ সালের লোকসভা ভোট, কলকাতার উপকণ্ঠের কেন্দ্রের এই সংলাপ বা দৃশ্য কেউ কেউ আজও মনে রেখেছেন। দু-দুটো রাত পেরিয়েও যখন ব্যালট সাগরে খাবি খাওয়া চলছেই দলের তরুণ এজেন্ট ক্লান্তিতে, হতাশায় ভেঙে পড়েছিলেন। ক্লান্তিকর টেস্ট ম্যাচ বা অন্তহীন ম্যারাথনের মতো সেই ভোটগুনতির শেষে তৃণমূলই সিপিএমকে টেক্কা দিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ গণনা পর্ব ভোটকর্মী, এজেন্ট সবারই আয়ু নিংড়ে নেয়।

দক্ষিণবঙ্গের এক পোড়খাওয়া তৃণমূল নেতা সে-কালের গণনা পদ্ধতিকে মুড়ি-বাদাম মেশানোর সঙ্গে তুলনা করেন। লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত একএকটি বিধানসভা এলাকার সব ব্যালট একটা মস্ত ড্রামে ফেলে মিশিয়ে ওলটপালট করা হতো। তার পরে ব্যালট গোনা শুরু।

রাজ্যের বহু ভোটযুদ্ধের সাক্ষী,শীর্ষ স্তরের এক আমলা বলছেন, “দেশের ভোটব্যবস্থায় টি এন শেষনের অবদানের এও এক নমুনা। এ ভাবে গুনতে সময় লাগত অনেক বেশি। কিন্তু আজকের মতো বুথ ধরে ধরে ফলাফল বুঝে ফেলা বা কোন পাড়া কাদের ভোট দিয়েছে ধরে ফেলার সুযোগ ছিল না। যে যাই বলুক, গুনতে যতই কষ্ট হোক গণতন্ত্রের জন্য ওই ব্যবস্থাই স্বাস্থ্যকর ছিল।”

ভোটযন্ত্র নিয়ে অনেক অভিযোগের এ-ও একটি। আর এক সরকারি কর্তার কথায়, “এই মেরুকরণ বা উগ্র রাজনৈতিক বিদ্বেষের যুগে কোন বুথ কাদের ভোট দিচ্ছে সবটা খোলসা হওয়া সবার জন্য স্বস্তির নাও হতে পারে। ভোটযন্ত্র, ভিভিপ্যাট নিয়ে নানা সংশয়ের মতো এটাও দুশ্চিন্তার বিষয়। ইভিএম ব্যবস্থা নানা ভাবেই উন্নত করা উচিত।”

সে-কালে রাত বাড়লে বিরোধী বা শাসক দলের এজেন্ট এসে খোদ ডিএম সাহেবের শরণাগত হয়ে ‘আমারে ডুবায়েন না স্যর’, বলে ঘুমোতে চলে গিয়েছেন। ভোটকর্মীরা অনেকেই তিন রাত পার করে গণনাকেন্দ্রের শৌচাগারে নামমাত্র জলে স্নান সেরে যৎসামান্য ঘুমিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

তবে ইভিএম যুগেও ভোট গুনতি বিষয়টি যে মোটে সোজা নয়, তা নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম শুভেন্দু অধিকারী টক্করেই দেখা গিয়েছিল। বাম আমলের বিখ্যাত লোডশেডিংয়ে অন্ধকারে ব্যালটে বিচিত্র কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। সার্ভার ডাউন এবং কয়েক মিনিটের বিদ্যুৎ বিভ্রাটে নন্দীগ্রামে মমতা-শুভেন্দুর ভোট গুনতি নিয়েও কম জটিলতা হয়নি।

চুলচেরা ফারাকের ভোটে কখন ফল ঘোষণা হবে সেই সিদ্ধান্তও প্রশাসনের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। ২০০১-এর বিধানসভা ভোটে সুজন চক্রবর্তী তৃণমূলের অরূপ ভদ্রের কাছে মোটে পাঁচ ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। গণনা নিয়ে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগে তার আগে উত্তেজনার পারদ ওঠে তুঙ্গে। এ দিকে, মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক সব্যসাচী সেনও বিলম্বিত গণনায় উদ্বিগ্ন। কিন্তু ফল ঘোষণা হয় প্রায় রাত তিনটেয়। জনৈক সরকারি কর্তার কথায়, “ব্যালট যুগের রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের মেজাজ বুঝে ধীরে গোনাও ছিল কৌশল। রাত বাড়লে লোকে অধৈর্য হয়ে চলে গেলেই বাঁচোয়া। ইভিএমে সে-সুবিধা নেই।” উত্তরবঙ্গের স্কুলশিক্ষক পোড়খাওয়া ভোটকর্মী আবার বলছেন, “ইদানীং বুথের মতো গণনাকেন্দ্রেও প্রভাবশালী দল ফুটবলের গেমসম্যানশিপের মতো মানসিক চাপ তৈরি করতে থাকে। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েও সব কিছু সামলানো মুশকিল।”

প্রযুক্তির আমূল বদলেও ভোট নিয়ে চিরকালীন আশা, ভয়ের ধুকপুকুনি আজও কাঁপতে থাকে।

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Lok Sabha Election 2024 West Bengal Technology

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy