কত সেনা চলেছে সমরে!
পোশাকি পদ তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু আসলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলের সেনাপতি। অনুগামীরা অনেক দিন ধরেই ‘সেনাপতি’ আখ্যা দিচ্ছিলেন। গত মার্চে দলীয় প্যাডে অভিষেককে ‘সেনাপতি’ বলে উল্লেখ করেন সুব্রত বক্সীও। মুকুল রায় বিজেপিতে যাওয়ার পর তৃণমূল থেকে ‘সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক’ পদ কার্যত লাটে উঠেছিল। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেককে সেই পদে নিয়োগ করেন। তরুণ তুর্কি নেতা দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসার পরেই জানান, তৃণমূল শুধু বাংলায় সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে না। সরকার গঠনের লক্ষ্য নিয়ে পাড়ি জমাবে বিভিন্ন রাজ্যে। কিন্তু গোয়া, মেঘালয় এবং ত্রিপুরায় সে চেষ্টা ব্যর্থ। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো জাতীয় দলের মর্যাদাও খুইয়েছে বাংলার শাসকদল। কিন্তু সেনাপতির ‘যুদ্ধ’ থামেনি। আপাতত তিনি এবং তাঁর সেনানী ব্যস্ত বাংলা নিয়ে।
যুব্-যুবা-যুব্
২০১১ সালে মমতা ক্ষমতায় আসার পরেই অভিষেকের সক্রিয় রাজনীতি শুরু। তখনই তৈরি হয়েছিল তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সমান্তরাল সংগঠন ‘যুবা’। শীর্ষে অভিষেক। তখন শুভেন্দু অধিকারী যুব তৃণমূলের সভাপতি। সেই থেকেই যুব বনাম যুবার সংঘাত শুরু। ক্রমে যুবা মিশে যায় দলের মূল যুব সংগঠনের সঙ্গে। অভিষেক তার সভাপতি হন। শুভেন্দুর সঙ্গে সংঘাত আরও বাড়ে। কালক্রমে শুভেন্দু তৃণমূল ছাড়েন। অভিষেক রয়ে যান যুব সভাপতির পদেই। পদোন্নতি হওয়ার আগে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ওই পদে।
গাব-গুবা-গুব
এই সে দিন পর্যন্তও তিনি ছিলেন গাবলু-গুবলু। ২০১৪ সালে যখন প্রথম লোকসভা ভোটে দাঁড়ালেন, তখনও গাবগুবাগুব চেহারা নিয়ে লম্বা পদযাত্রায় হাঁপিয়ে উঠতেন। সেই তিনিই ওজন ঝরিয়ে এখন ছমছমে। রোখা চোয়াল। লম্বা গ্রীবা। দেহে এক ছটাক বাড়তি মেদ নেই। কব্জিতে শোভিত আধুনিক ফিটনেস ট্র্যাকার। তাঁর খাদ্যতালিকা এবং খাদ্যাভ্যাস নিয়ে চারদিকে আলোচনা নিরন্তর। তিনি অবশ্য বলেন, দু’বেলা সিপিএম-বিজেপি-কংগ্রেসের গালিগালাজই তাঁর ‘ডায়েট’। যিনিই নিয়মিত খাবেন, তাঁরই ওজন ঝরে যাবে!
প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে রাজ্যে সিপিএমের বিরোধিতা বাড়ছিল। অধুনালুপ্ত ‘অর্কুট’-এ তখন তৃণমূল সমর্থকদের একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। সেখানে লেখালিখি করতেন অভিষেক। কিন্তু তাঁর প্রথম প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচি কী? অনেকে বলেন, ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর ২১ জুলাইয়ের ব্রিগেড সমাবেশ। কিন্তু তৃণমূলশ্রীরা জানেন, ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কসবার তৃণমূল প্রার্থী জাভেদ আহমেদ খানের প্রচার মিছিলে বিজন সেতু থেকে পদযাত্রায় হেঁটেছিলেন অভিষেক। সেই মিছিলেই হেঁটেছিলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র সায়নদেব, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র শীর্ষাহ্ন, শশী পাঁজার মেয়ে পূজা পাঁজা, অরূপ চক্রবর্তীরা।
ডায়মন্ড সিস্টেম
২০১৪ সালে ডায়মন্ড হারবার থেকে লোকসভার সাংসদ হন অভিষেক। তৃণমূলের অনেকে মনে করেন, চাইলে রাজ্যসভার সাংসদও হতে পারতেন। মমতাও একাধিক বার বলেছেন, তিনি অভিষেককে রাজ্যসভায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অভিষেকই রাজি হননি। তিনি দলনেত্রীকে বলেছিলেন, সংসদে গেলে মানুষের ভোটে জিতেই যাবেন। মানুষের ভোটে জিতেই পর পর দু’বার ডায়মন্ড হারবার থেকে সাংসদ হয়েছেন অভিষেক। এ বার তাঁর জয়ের হ্যাটট্রিক করার ভোট।
অতি প্রশান্ত
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বাংলায় বেনজির ধাক্কা খেয়েছিল তৃণমূল। ১৮টি আসন জিতে নিয়েছিল বিজেপি। ক্ষত মেরামতে অভিষেক নিয়ে আসেন প্রশান্ত কিশোরকে। নবান্নে মমতার সঙ্গে একান্তে বৈঠক হয়। অতঃপর তৃণমূলের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন প্রশান্ত। কাজ শুরু করে তাঁর সংস্থা আইপ্যাক। ঘটনাচক্রে, প্রশান্ত ছিলেন ২০১৪ সালে ‘টিম নরেন্দ্র মোদী’র সঙ্গে। দু’বছর পরে ২০২১ সালে বাংলা দখলে সর্বশক্তি লগ্নি করেছিল বিজেপি। পারেনি। প্রশান্ত নিয়ে এসেছিলেন তাঁর অমোঘ স্লোগান ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’। তৃণমূলের প্রশান্তি বিঘ্নিত হয়নি। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে জয়ের পরে অভিষেকের নেতৃত্বও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তৃণমূলে। তৃণমূলকে জিতিয়ে প্রশান্ত অবশ্য আর বাংলায় থাকেননি। তবে তাঁর সংস্থা এখনও নিবিড় ভাবে কাজ করে এই রাজ্যে।
১০ মিনিট!
বব বিশ্বাস বলতেন, এক মিনিট। তিনি বলেন, দশ মিনিট! অভিষেকের ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে সব ঘড়ির সময় ১০ মিনিট এগিয়ে রাখা। যাতে কখনও কোনও বৈঠক শুরু হতে দেরি না হয়। কেউ যেন সময়ের অজুহাতে কোনও বৈঠকে দেরিতে না পৌঁছন। যাতে সাড়ে ১০টার বৈঠকে লোকে পৌঁছে যায় ১০টা ২০ মিনিটেই। এটা কি সাংগঠনিক বাঁধুনির উপরেও একটা ‘কর্পোরেট’ মোড়ক? হতে পারে। না-ও পারে। সেটা যার যার নিজস্ব ব্যাখ্যা। কিন্তু এই বার্তা নির্ভুল যে, তৃণমূলের সেনাপতির দফতরে সবচেয়ে দামি সময়।
নবজোয়ার
অপ্রতিভ। একটু দূরত্বের। জনতা ছুঁয়ে দেখতে পারে না। এমনই ছিল তাঁর সম্পর্কে ধারণা। ‘মাটির কাছাকাছি’ যেতেই ২০২২ সালে ‘নবজোয়ার যাত্রা’ করেন অভিষেক। রাজ্যের সমস্ত জেলায় গিয়েছিলেন তিনি। রাস্তায় ছিলেন টানা দু’মাসেরও বেশি। সেই যাত্রা তৃণমূলে অন্য এক অভিষেকের জন্ম দিয়েছিল। শুরুতে তৃণমূলের অনেকে সন্দিহান ছিলেন— পারবেন তো? অভিষেক পেরেছিলেন। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সিবিআইয়ের তলবে হাজিরা দেওয়ার জন্য এক দিনের বিরতি দিতে হয়েছিল। হাজিরা দিয়ে ফিরে গিয়ে আবার মিশে গিয়েছিলেন নবজোয়ারে।
দিল্লি চলো!
অভিষেকের রাজনীতি বরাবর ‘শাসক’ হিসেবে। তাঁর রাজনীতিতে খামতি ছিল ‘বিরোধী’ ভূমিকার। সেই আখ্যান তৈরি হল কেন্দ্রের বিরোধিতা দিয়ে। এবং তা-ও একেবারে দেশের রাজধানীতে! ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ১০০ দিনের কাজ-সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বাংলার ‘বকেয়া’ আদায়ের জন্য দিল্লি অভিযান করেছিলেন অভিষেক। রাজঘাটে ধর্না, কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকে ধর্না, রাতে পুলিশের হাতে গ্রেফতারি— অভিষেকের ‘দিল্লি চলো’ সাড়া ফেলে দিয়েছিল জাতীয় রাজনীতিতে।
অভি-মান
দিল্লি থেকে ফিরে রাজভবনের অদূরে টানা অবস্থানে বসেছিলেন অভিষেক। পুজোর আগে মমতার অনুরোধে ধর্না তুলে নেন। কিন্তু ঘোষণা করেন, ১ নভেম্বর থেকে আবার শুরু হবে আন্দোলন। হয়নি। দুষ্টু লোকেরা তার কারণ হিসেবে নানা কথা বলে। যদিও প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলে না। সে যা-ই হোক, অভিষেক নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেন নিজস্ব গণ্ডিতে। দলীয় কর্মসূচিতে গরহাজির হতে শুরু করেন। সেই ‘সন্ধিক্ষণে’ই অভিষেকের প্রকাশ্য অভিমত নিয়ে তৃণমূলে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব তুঙ্গে পৌঁছয়। দলের মতানৈক্য প্রকাশ্যে চলে আসে। অভিষেকের সঙ্গে দলের দূরত্ব আরও বাড়ে। কাগজ পড়াও বন্ধ করে দিয়েছিলেন শাসক শিবিরের সেনাপতি।
অভি-যোজন
প্রায় চার মাস দলের মূলস্রোত থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলেন অভিষেক। নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন ডায়মন্ড হারবারের গন্ডিতে। অবশেষে সন্দেশখালির ঘটনার পরে তৃণমূল যখন বেকায়দায়, তখন নেত্রীর নির্দেশে সক্রিয় হন সেনাপতি। পরিস্থিতির সাপেক্ষে নিজস্ব অভিযোজন শুরু হয় তাঁর। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ডায়মন্ড হারবারের চৌকাঠ পেরিয়ে আবার রাজ্যের দায়িত্ব হাতে নেন তিনি। ব্রিগেড সমাবেশ থেকে লোকসভা ভোটের প্রচার— সবটাই তাঁর নকশা।
অভি-যুক্ত
কয়লা পাচার মামলা এবং নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় নাম জড়িয়েছে অভিষেকের। তাঁর স্ত্রী, শ্যালিকা, ভায়রা ভাই, শ্যালিকার শ্বশুর, এমনকি, বাবা-মাকেও তদন্তের আতশকাচের নীচে রেখেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। এক বার তাঁর শ্যালিকাকে বিমানে উঠতে না-দিয়ে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় এজেন্সি। অভিষেকের স্ত্রী রুজিরা দু’বার ইডি দফতরে হাজিরা দিয়েছেন। ইতিমধ্যে মোট ১২ বার অভিষেককে তলব করেছে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। অভিষেক অধিকাংশ সময়েই হাজিরা দিয়ে টানা জেরার মুখোমুখি হয়েছেন। তার পরে বেরিয়ে মুণ্ডপাত করেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের।
সব খেলার সেরা
রাজনীতির পাশাপাশি খেলাধুলোতেও আগ্রহী। বেশি পছন্দের খেলা ক্রিকেট। তবে কিনা ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’! অতএব নিজের লোকসভা কেন্দ্রে ‘ডায়মন্ড হারবার এফসি’ নামে একটি ফুটবল ক্লাব করেছেন অভিষেক। তারা কলকাতা ফুটবল লিগেও খেলছে। ডায়মন্ড হারবারে মহা ধুমধামে ‘এমপি কাপ’-এরও আয়োজন করে থাকেন তিনি প্রতি বছর।
শোভে গ্রামোফোন
জন্ম কলকাতায়। ১৯৮৭ সালের ৭ নভেম্বর। পড়াশোনা নব নালন্দা, এমপি বিড়লা ফাউন্ডেশনে। স্কুলের পাঠ শেষ করার পর দিল্লিতে উচ্চশিক্ষা। বিবিএ, এমবিএ। দিল্লিতেই তাইল্যান্ডের নাগরিক রুজিরা নারুলার সঙ্গে সম্পর্ক। প্রেম। ২০১২ সালে বিয়ে। অভিষেক-রুজিরার দুই সন্তান। কন্যা আজানিয়া এবং পুত্র আয়াংশ। আজানিয়া মমতার ন্যাওটা। আয়াংশ ‘স্পাইডারম্যান’-এর ভক্ত। ২৪ ঘণ্টার রাজনীতিক পিতা অবশ্য টানা সময় দিতে পারেন না পরিবারকে। সপ্তাহান্তে ভিডিয়ো কল-এ কথা হয় সন্তানদের সঙ্গে।
রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy