Advertisement
Back to
Lok Sabha Election 2024

দুই মেরুর আড়ালে গোপন অঙ্কের ফল্গুও

বারাসতের ‘দিদি’, অর্থাৎ বিদায়ী সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের সাংসদ হিসেবে হ্যাটট্রিক হয়ে গিয়েছে। আর এই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু-প্রধান দেগঙ্গা বিধানসভা সত্যিই বড় ভরসা তৃণমূলের।

vote

—প্রতীকী চিত্র।

সুজিষ্ণু মাহাতো
বারাসত শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৪ ০৮:২৪
Share: Save:

দেগঙ্গা বাজারের মধ্যের রাস্তাটা কার্যত সীমানা। এক দিকের এলাকা বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রে। আর এক দিক বারাসত কেন্দ্রে। এমন ভারসাম্য ধরে রেখে রাস্তাটা যেন বারাসত কেন্দ্রের মতোই প্রতীকী!

কারণ, বারাসত কেন্দ্রেও যেন সেই ভারসাম্যেরই খেলা! এক দিকে সল্টলেক-নিউটাউনের অভিজাত শহরাঞ্চল, অন্য দিকে দেগঙ্গা-হাবড়া-অশোকনগরের গ্রাম। এক দিকে স্মার্ট সিটিতে অবাঙালি ভোটারদের মধ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তা, অন্য দিকে গ্রামের মহিলাদের মধ্যে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারে’র প্রভাব। এমন দ্বিমেরুকরণ সহজ হলেও ফল্গুধারার মতো
তলায় বইছে নানা স্রোত। তাই হিসেব সোজা নয়।

‘‘গত বার ছিল সোজা হিসেব’’, দেগঙ্গা-হাবড়া পথে পৃথিবা মোড়ের পানের দোকানে বললেন এক বৃদ্ধ। ‘‘ঘর পোড়ে পুড়ুক, ছারপোকা তো মরছে!’’ তার পরেই বুঝিয়ে দিলেন। ‘‘আমরা লালপার্টি করি। কিন্তু আঠেরোর পঞ্চায়েতে যে গা-জোয়ারি ভোট হয়েছিল, সেই রাগে ছারপোকা মারতে পদ্মফুলে দিয়েছি! এ বার নয়।’’ তা হলে তো তৃণমূলেরই লাভ? ‘‘অত সহজ নয়! ঘর পোড়াতে না চাইতে পারি, কিন্তু ছারপোকা থাকুক, তা-ও কেন চাইব? দেগঙ্গার ভোটই তো দিদির ভরসা! দেখুন না কী হয়!’’

বারাসতের ‘দিদি’, অর্থাৎ বিদায়ী সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদারের সাংসদ হিসেবে হ্যাটট্রিক হয়ে গিয়েছে। আর এই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু-প্রধান দেগঙ্গা বিধানসভা সত্যিই বড় ভরসা তৃণমূলের। পাঁচ বছর আগে কাকলি জিতেছিলেন ১ লক্ষ ১০ হাজারের বেশি ভোটে। দেগঙ্গায় তাঁর ‘লিড’ ছিল প্রায় ৭৪ হাজার। সল্টলেক ও হাবড়া, দুই বিধানসভাতেই বিজেপির কাছে প্রায় প্রায় ২০ হাজার ভোটে পিছিয়ে থাকলেও দেগঙ্গা একাই সেই ‘ক্ষতি’ পুষিয়ে দিয়েছিল।

উনিশে তৃণমূলের দেগঙ্গার লিড একুশের বিধানসভা ভোটে এক ধাক্কায় নেমে চলে আসে সাড়ে ৩২ হাজারে। কারণ, আইএসএফ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা আইএসএফ প্রার্থী পেয়েছিলেন ৬৭ হাজারেরও বেশি ভোট। এ বারও দেগঙ্গা-হাবড়ার নানা এলাকায় উড়ছে আইএসএফের পতাকা। কাকলি অবশ্য ‘রিল্যাক্সড’। তাঁর যুক্তি, ‘‘আমরা সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু এমন ভাগ করে রাজনীতি করি না। কাজের ভিত্তিতে ভোট চাইছি। বারাসত সংসদীয় এলাকা কী অবস্থায় পেয়েছিলাম, আর এখন কী কী করতে পেরেছি, তা বিচার করেই সব বিধানসভার মানুষ আবার আমায় ভোট দেবেন।’’

বারাসতে তাঁর নানা কাজের তালিকা দিয়ে পুস্তিকা তৈরি করে প্রচার করছেন চিকিৎসক কাকলি। তবে দেওয়াল লিখনে সর্বত্রই প্রাধান্য ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারে’র। প্রায় ১৯ লক্ষ ভোটারের বারাসত কেন্দ্রে মহিলা ভোটার প্রায় অর্ধেক। তাই কি ভোটে জিততে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ বড় ভরসা? কাকলির মুখে বামপন্থী নারীবাদের কথা। বলছেন, ‘‘ক্লারা জ়েটকিন থেকে এমেলিন প্যাঙ্কহার্স্ট— নারীদের জন্য লড়াইটা শুরু তো অনেক আগে থেকেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই সেটা করছেন। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ সেই লড়াইয়েরই একটা স্বীকৃতি।’’

লোকসভা কেন্দ্রের নানা এলাকা জুড়েই ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারে’র মতো প্রকল্পের প্রভাব যেমন আছে, তেমনই সরকারি পরিষেবায় বঞ্চনার কিছু ক্ষোভও আছে। নিচু তলায় এমন বঞ্চনার অভিযোগকেই হাতিয়ার করে প্রচার করছে বিজেপি। হাবড়ায় প্রচারের ফাঁকে বিজেপি প্রার্থী, স্বপন মজুমদার বললেন, ‘‘কাকলিদেবীর ভরসা শুধু দেগঙ্গা। সেখানে এ বার তৃণমূলের ‘লিড’ কমবে। এই কেন্দ্রে ২০%-এর বেশি মতুয়া ভোটের পুরোটাই পাব, আর দিল্লির ভোটে জাতীয় দল বিজেপি এমনিতেই ২০% ভোট বেশি পাবে। তাই একুশের অঙ্ক মিলবে না।’’

কিন্তু অঙ্ক কি এতই সহজ? সিএএ-বিতর্কের পরে মতুয়া মন কোন দিকে, তার পরীক্ষা এখনও হয়নি। তার উপরে স্বপনের বিরুদ্ধে মাদক মামলা থাকার অভিযোগে বিতর্ক বেধেছিল। আপত্তি এসেছিল দলের একাংশের থেকেও। স্বপন নিজে এবং দলের তরফে তার জবাব দেওয়া হলেও ভোটে তার প্রভাব পড়তেই পারে বলে চর্চা চলছে। এ যদি বিজেপির ‘ব্যথা’ হয়, তা হলে তৃণমূলের ‘ব্যথা’ হাবড়ার বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় (বালু) মল্লিকের গ্রেফতারি। হাবড়া ঘুরলেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, বালু না থাকায় সেখানে শাসক দলের সংগঠন বেশ কিছুটা দুর্বল। অনেক নেতা নাকি জল মাপছেন! তাই গত লোকসভায় পিছিয়ে থাকা যে হাবড়া একুশে ‘পুনরুদ্ধার’ হয়েছিল, এ বার ৪ জুন সেখানে বিখ্যাত মাখা সন্দেশ খেয়ে উদ্‌যাপন করতে পারবেন কি না তৃণমূল কর্মীরা, তা নিয়ে চর্চা রয়েছে।

দুই ফুলের শিবিরের এই দুই ‘কাঁটা’র মধ্যে লড়াইয়ে আছে বামেরাও। উনিশের ভোটে বারাসতে বিজেপির ভোট বেড়েছিল ১৫%। বাম তথা ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থীর ভোট কমেছিল ১৮%। তবে এ বার আগের হিসেব যে মিলবে না, তা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সঞ্জীব নিজে বারাসত পুরসভার উপ-পুরপ্রধান ছিলেন। পুরভোটে জিতেছেন তৃণমূল আমলেও। দলের দফতরে ভোট-প্রস্তুতির ছাপ স্পষ্ট। সঞ্জীব বললেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে সিপিএমের পুরো সংগঠন নেমেছে। কংগ্রেসও আছে। আগের বার সল্টলেকে, দত্তাবাদে, নিউটাউনের অনেক জায়গায়, অশোকনগরের কিছু জায়গায় আমরা প্রচার করতে পারিনি। এ বারে সর্বত্র যাচ্ছি। মানুষকে বলছি, এক দিকে চাকরি-দুর্নীতি, অন্য দিকে দেশ-বিক্রি, ধর্মের রাজনীতির বাইরে আমাদের দিয়ে দেখুন। মানুষ সাড়া দিচ্ছেন।’’

তবে বাম ভোটারেরা যে তাঁদের ডাকেই সাড়া দেবেন, সেই দাবি করছেন আইএসএফ প্রার্থী তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, ‘‘বলা হচ্ছে আমরা শুধু দেগঙ্গায় শক্তিশালী। বাস্তবে রাজারহাট থেকে অশোকনগর, সব এলাকা মিলিয়ে গত বছর একশোরও বেশি পঞ্চায়েতের আসনে আমরা জিতেছি প্রবল সন্ত্রাসের মধ্যে।’’ তবে বামেদের সঙ্গ ছাড়া আইএসএফ কী করতে পারবে, তার পরীক্ষা হবে এ বারই। আবার আইএসএফের সমঝোতা পছন্দ না হওয়ায় গত বিধানসভা ভোটে অশোকনগর (আইএসএফের প্রার্থী ছিলেন তাপসই)-সহ কিছু এলাকায় সিপিএমের যে কর্মী-সমর্থকেরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা এ বার ফের পুরোদমে সঞ্জীবের হয়ে নেমেছেন।

ফলে, অঙ্কের কাটাকুটি জটিল!

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2024 Spot Reporting Barasat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE