Advertisement
E-Paper

চকচকে পিচরাস্তার ধারে অনিয়মের কালি

গাডরাসিনি পাহাড়ে ওঠার রাস্তায় এসে চমকাতে হল! লাল মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তাটি উধাও! চকচকে চওড়া পিচের রাস্তা তৈরির কাজ চলেছে জোরকদমে। বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বংশীবদন মাহাতো অবশ্য জানিয়েছিলেন, উন্নয়নের রাস্তা দিয়ে প্রত্যন্ত সব এলাকা জুড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা।

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
চাকাডোবা থেকে কাঁকড়াঝোর যাওয়ার নতুন পিচ রাস্তা।

চাকাডোবা থেকে কাঁকড়াঝোর যাওয়ার নতুন পিচ রাস্তা।

গাডরাসিনি পাহাড়ে ওঠার রাস্তায় এসে চমকাতে হল! লাল মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তাটি উধাও! চকচকে চওড়া পিচের রাস্তা তৈরির কাজ চলেছে জোরকদমে। বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বংশীবদন মাহাতো অবশ্য জানিয়েছিলেন, উন্নয়নের রাস্তা দিয়ে প্রত্যন্ত সব এলাকা জুড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। আদিবাসী সংরক্ষিত বিনপুর বিধানসভা এলাকার অন্তর্গত বেলপাহাড়ি ব্লকে ১৭টি নতুন রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। সব মিলিয়ে দেড়শো কিলোমিটার নতুন পিচের রাস্তা! বছরখানেক আগে কাজ শেষ হওয়া চাকাডোবা থেকে কাঁকড়াঝোরের রাস্তাটাও বেশ ভাল হয়েছে। ময়ূরঝর্নার কাছে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য প্যাকেজ ট্যুরে লোকজন আসছেন। কিন্তু এই নয়নাভিরাম দৃশ্যপটের আড়ালে বাসিন্দাদের দীর্ঘশ্বাসও কিন্তু চাপা থাকছে না। চাকাডোবার চায়ের দোকানে আয়েস করে চা খাওয়ার ফাঁকে ওড়লির ভীম সিংহ জানালেন, দু’টাকা কিলো দরে চাল পাচ্ছি, ছেলেপুলেরা স্কুল থেকে সাইকেল পেয়েছে। মাঝেমধ্যে পুলিশ-সিআরপি’র উদ্যোগে দান খয়রাতির শিবির হয়। সেখানে গেলে মুফতে পেটপুরে খিচুড়ি, বিনে পয়সায় ওষুধ, জামাকাপড়, ঘরগেরস্থালির সরঞ্জাম অনেক কিছু পাওয়া যায়। ভীমবাবু জানালেন, তাঁরা ভালই আছেন। তবে শুনতে পান উন্নয়নে অনেক টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু সে সব টাকা কোথায় যে যায় সে হদিশ অবশ্য মেলে না। খোঁজ নেওয়ার চেষ্টাও করেন না তাঁরা।


তৈরি হচ্ছে গাড়রাসিনি যাওয়ার পিচরাস্তা।

এই যেমন সন্দাপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের কথাই ধরা যাক। ধুলো ওড়ানো রাস্তা উজিয়ে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছে অবাক হওয়ার পালা। পথচলতি বাসিন্দা মন্মথনাথ কদমা, রুপালি নায়েক-রা জানালেন, স্রেফ জলের অভাবে সপ্তাহের সব দিন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রটি খোলা হয় না। বেশ কিছু ক্ষণ অপেক্ষার পরে দেখা মিলল, উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী মঞ্জুলা মাহাতোর। তিনি জানালেন, জল না থাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের শৌচাগারগুলি ব্যবহার করা যায় না। পর্যাপ্ত পরিস্রুত জলের অভাবে যক্ষ্ণা রোগীদের ওষুধ খাওয়ানো, অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের মূত্র পরীক্ষা ও অস্থায়ী বন্ধ্যাত্বকরণ কর্মসূচি ব্যাহত হয়। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে বার বার হাত ধুতে হয়। জলের অভাবে সেটাও সমস্যা। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কিছুটা দূরে সন্দাপাড়া গ্রামের একটি গভীর নলকূপের জল বয়ে আনতে হয়।

কেন এমন পরিস্থিতি?

গত বিধানসভা ভোটে জঙ্গলমহল তৃণমূলময় হয়ে উঠলেও ব্যতিক্রম ছিল বিনপুর বিধানসভা এলাকা। এখানে গত বার সিপিএমের দিবাকর হাঁসদা জয়ী হন। এ বারও দিবাকরবাবু সিপিএম প্রার্থী। ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটে বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতি-সহ ব্লকের দশটি গ্রাম পঞ্চায়েতের সব ক’টি দখল করে নেয় তৃণমূল। বাসিন্দাদের থেকে জানতে পারলাম, বাম জমানায় বছর দশেক আগে সন্দাপাড়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভবনটি তৈরি হয়। ওই সময় পাইপলাইন ও ট্যাঙ্ক বসানো হয়। কিন্তু জলের পাম্প আর বসেনি। ২০১৩ সালে সন্দাপাড়া পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় তৃণমূল আসার পরে ২০১৩-’১৪ অর্থবর্ষে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য জলপ্রকল্প তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৪-র অক্টোবরে কাজটি হয়ে গিয়েছে বলে বিডিও’র কাছে রিপোর্টও জমা পড়ে যায়। বাস্তবে কাজটি হয়নি। বছর দশেক আগের পুরনো ট্যাঙ্ক ও ভাঙা পাইপ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না।


পানিচুবকির খারাপ টিউবওয়েল

স্বাস্থ্যকর্মী মঞ্জুলাদেবী জানালেন, বহু বার প্রশাসনিক মহলে অভিযোগ জানানো হয়েছে, কিন্তু জলের সুরাহা হয়নি। এখন সবে বসন্তের মাঝামাঝি। তাতেই দুপুর-রোদে বেশ ঝাঁঝ। পানীয় জলেরও সমস্যা শুরু হয়ে গিয়েছে। কয়েক কিলোমিটার দূরে ছোটজামশোল, বড় জামশোল, পানিচুবকির মতো গ্রামগুলিতে পানীয় জলের তীব্র হাহাকার। এর মধ্যেই পুকুর-ডোবা শুকিয়ে কাঠ। সরকারি কয়েকটা টিউবওয়েল চোখে পড়ল, তাতে জল ওঠে না। একটা টিউবওয়েলে জল উঠছে, তবে আয়রন ওঠা দুর্গন্ধ-জল খাওয়ার অযোগ্য। ফলে, পাতকুয়ো কিংবা প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় ঝরনার জলই ভরসা। বড় জামশোল ও পানিচুবকি গ্রামের মাঝামাঝি একমাত্র সরকারি পাতকুয়োয় জল নেওয়ার ভিড়। দু’টি গ্রামের শ’খানেক পরিবারের ভরসা ওই পাতকুয়ো। জল নেওয়ার ফাঁকে অন্নপূর্ণা দত্ত, কল্পনা হালদার-রা ঝাঁঝিয়ে জানালেন, তাঁদের গ্রামে কাগজে-কলমে উন্নয়ন হয়েছে। বরাদ্দ টাকা হজম হয়ে গিয়েছে। পানিচুবকি অঙ্গওয়াড়ি কেন্দ্রের প্রাঙ্গণে কোনও পাতকুয়োই নেই। অথচ, সেই পাতকুয়োর চাতাল বাঁধানোর জন্য বরাদ্দ ৬ হাজার ৪৯০ টাকা খরচ দেখিয়েছে সন্দাপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত। স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য তড়িৎকুমার হাঁসদার বাড়ি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের একেবারে পাশে। ডাকাডাকি করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন তড়িৎবাবু। পাতকুয়োর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাথা চুলকে অপ্রস্তুত তড়িৎবাবু জানালেন, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের প্রাঙ্গনে পাতকুয়ো কোনও দিনই ছিল না। তবু চাতাল সংস্কারের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। বুঝতেই তো পারছেন, দেঁতো হাসিতে বললেন তিনি।


পানিচুবকির একমাত্র কুয়ো

এখানেই শেষ নয়। সন্দাপাড়া, ভেলাইডিহা, শিলদার মতো বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতে ভূরি ভূরি অস্তিত্বহীন প্রকল্পে টাকা খরচের অভিযোগে আন্দোলন শুরু করেছে কংগ্রেস। ঝাড়গ্রাম জেলা কংগ্রেস সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য জানালেন, পঞ্চায়েতের দুর্নীতি নিয়ে প্রশাসনিক মহলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেওয়া সত্ত্বেও কোনও কাজ হয়নি। একশো দিনের প্রকল্পে কাজ করেও প্রায় তিন বছর মজুরি পাননি ভুলাভেদার কানাই সর্দার, চাঁদাবিলার নারায়ণ মাণ্ডির মতো কয়েকশো বাসিন্দা। ব্লক অফিসে খোঁজ নিতে আসা কানাইবাবু বললেন, ‘কিছুই বদলায়নি। কাজ করেছি আমরা, টাকা ঢুকছে অনেক অ্যাকাউন্টে।’ ওদলচুয়ায় রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে বসেছিলেন বাস ধরতে আসা ডগমণি সরেন। ফিসফিসিয়ে জানালেন, পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছে। এ জন্য শাসকদলের নেতারাই দায়ী। সেচ নেই। বৃষ্টি অভাবে আমন ধান শুকিয়ে গেল। খরা ঘোষণা হল না। এক জন চাষিও ক্ষতিপূরণ পেলেন না। আর নেতারা ফুলে ফেঁপে উঠছেন। বাম আমলে তৈরি হওয়া ওদলচুয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এখনও অন্তর্বিভাগ চালু হল না। ওদলচুয়ার বাসিন্দা হরিপদ কিস্কু, মঙ্গলি হাঁসদা, কটুচুয়া গ্রামের বৈদ্যনাথ হেমব্রম, পূর্ণাপানি গ্রামের দিনুবালা মাহাতোরা জানালেন, গাঁ-গঞ্জে ডাক্তারবাবুরা নাকি থাকতে চান না। তাই রাতবিরেতে হাতুড়েরাই ভরসা। শিমূলপাল অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকার গুরুতর অসুস্থ রোগীদের নিয়ে ১৮-২০ কিমি দূরে সেই বেলপাহাড়ি গ্রামীণ হাসপাতালে ছুটতে হয়। কানে এল, এমন সব বঞ্চনার সুযোগ নিয়ে আড়ালে থাকা মাওবাদীরা এলাকায় ফের জনমত তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে শাসকদলকে দুষে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া সীমান্ত এলাকায় ভোট বয়কটের জন্য তলে তলে প্রচারও চলছে।

ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

kingshuk gupta gadrasini jungle mahal west medinipur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy