Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কয়েক ঘণ্টায় ৭৫ শতাংশ! জঙ্গলমহলে মানুষের ‘সেবা’য় তৃণমূলীরা

বাইরে চৈত্রের ঠা-ঠা রোদ্দুর। ভেতরে ভোট চলছে। বুথের বাইরেটা যদিও খাঁ-খাঁ। কোথাও জনমুনিষ্যি নেই! অথচ, এই বুথেই দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যেই ৩৬০টি ভোট পড়ে গিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুরে ভিমার্জুন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই বুথে মোট ভোটারের সংখ্যা ৪৭৬। পাটি গণিতের হিসেব কষলে দেখা যাবে দুপুর গড়ানোর আগেই ৭৫ শতাংশ ভোট হয়ে গিয়েছে! তবে কি ভোট দিল ভূতে?

ব্যঙ্গচিত্র: অনুপ রায়

ব্যঙ্গচিত্র: অনুপ রায়

কিংশুক গুপ্ত
বেলপাহাড়ি শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ১৫:২৩
Share: Save:

বাইরে চৈত্রের ঠা-ঠা রোদ্দুর। ভেতরে ভোট চলছে। বুথের বাইরেটা যদিও খাঁ-খাঁ। তেমন একটা জনমুনিষ্যি নেই! অথচ, এই বুথেই দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যেই ৩৬০টি ভোট পড়ে গিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুরে ভিমার্জুন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই বুথে মোট ভোটারের সংখ্যা ৪৭৬। পাটি গণিতের হিসেব কষলে দেখা যাবে দুপুর গড়ানোর আগেই ৭৫ শতাংশ ভোট হয়ে গিয়েছে! ভোটের এই হারে চোখ কপালে উঠেছে বিরোধীদের!

নির্বাচন কমিশনের হিসেব, বেলা ৩টে পর্যন্ত গড়ে তিন জেলায় ৭৫.২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৮০.৪৪ শতাংশ। অথচ এই জেলার জঙ্গলমহলে বেশির ভাগ বুথেই বিরোধীদের দেখা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়নি ভোটারদেরও। তবে তাতে ভোট দানের শতাংশের হিসেবে যদিও কোনও প্রভাব পড়েনি। পাশাপাশি, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায় বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে যথাক্রমে ৭৯.৪৮ ও ৭৮.৮৩ শতাংশ।

বিনপুর বিধানসভার বেশির ভাগ জায়গাতেই দেখা গিয়েছে অন্য এক চিত্র। বুথ থেকে কয়েক পা দূরেই হয়েছে তৃণমূলের অস্থায়ী শিবির। শিবির মানে আসলে বুথের কাছাকাছি কোনও তৃণমূল নেতার বাড়ি। সেটাকেই শিবির বানিয়ে চলছে ভোটের কাজ। ভোট দিতে আসার পথে বা ফেরার সময় ভোটারদের সেখানে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খেতে দেওয়া হচ্ছে মুড়ি, ছোলা সেদ্ধ। কোথাও কোথাও তার সঙ্গে দেওয়া হয়েছে ভেজ-পকোড়া। সেই ‘শিবির’ থেকে কিছু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে কয়েক জনকে। যাঁরা ভোটারদের হাতে গুঁজে দিচ্ছেন ১০০ টাকার একটা কড়কড়ে নোট। এ সব পেয়ে ভোটাররা রীতিমতো খুশি। বলছেন, ‘কাল রাতে মাংসভাত খাইয়েছিল। আমরা খাইনি। তাই টাকাটা নিয়ে নিলাম।’ তাঁদের হাতে টাকা তুলে দিতে পেরে খুশি ওঁরাও। এই ওঁরা কারা? শাসক দলের লোকজন। তাঁরা যদিও নিজেদের জনতার সেবক বলছেন। আপনারা কি তৃণমূল? এ প্রশ্নের জবাব এল হাসিমুখে, ‘হ্যাঁ মানে না, ওই আর কি!’ কেন টাকা দিচ্ছেন? অবাক চোখে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছেন, ‘মানুষের সেবা করলেও দোষ?’

এ ছবি দেখা গিয়েছে বেলপাহাড়ি থেকে জামবনি— প্রায় সর্বত্রই। শাসক দলের লোকজনকেই দেখা গিয়েছে এ সব করতে। আর বিরোধীরা? আড়ালে আবড়ালে তাঁরাও রয়েছেন। কিন্তু, প্রকাশ্যে আসতে চাইছেন না কেউই। কারণ? তাঁদের অভিযোগ, শাসক দল গোটা এলাকা জুড়ে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। এলাকাবাসীরাও সে কথা সমর্থন করছেন। ভোটের আগে তৃণমূল প্রার্থী খগেন্দ্রনাথ হেমব্রমের সঙ্গে প্রচারে এসেছিলেন ব্লক তৃণমূলের সভাপতি বংশীবদন মাহাতো। সঙ্গে আট জন নিরাপত্তারক্ষী। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। জঙ্গলের মানুষ অস্ত্র অনেক দেখেছেন। কিন্তু, শাসক দলের নেতার সঙ্গে এমন অস্ত্রশস্ত্র দেখে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে তৃণমূল বাহিনীর রোজকার হুমকি। ভোটের আগের দিন থেকে সেই তালিকায় জুড়েছে মাংসভাত খাইয়ে ভোট কেনার চেষ্টা। দিনের দিন নগদ টাকা এবং ছোলা-মুড়ি। অথচ এ সব দেখার প্রাথমিক দায়িত্ব যাদের, সেই কেন্দ্রীয় বাহিনী যদিও কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকায় ছিল। বুথের ভেতর-বাইরের দায়িত্ব তাদের হাতে থাকলেও, এ দিন বুথের কয়েক পা দূরের বিষয়ে তারা নাক পর্যন্ত গলায়নি। বুথে তারা এমন ভাবেই সক্রিয় ছিল যে, নির্বাচন কমিশনের অনুমতিপত্র থাকা সত্ত্বেও সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের অনেক জায়গায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমলাশোলের মতো জায়গাতেও ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার ছবি তুলতে বাধা দেওয়া হয়েছে। পরে জেলার পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে কমিশনের সচিত্র পরিচয়পত্র দেখে ছবি তুলতে দেওয়া হয়।

তবে, শতাংশের হিসেবে ভোটের এই পরিসংখ্যান খুব একটা স্বস্তিতে রাখছে না বিরোধীদের। ফাঁকা বুথে ভোটকর্মীদের সামনে তবে কি ভোট দিয়ে গেল ভূতে? ভোটের দিনেও সরব হয়ে উঠল প্রশ্নটা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE