Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

চেনা মাঠ বেছে নিয়েই হার মানলেন সেনাপতি

অঙ্ক তাঁর সহায় ছিল না। তবু রণক্ষেত্র ছাড়েননি সেনাপতি। মাটি আঁকড়েই লড়াই চলেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভূমিপুত্রকে খালি হাতেই ফেরাল নারায়ণগড়। নিজের কেন্দ্রে বিরোধী দলনেতা এবং সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হেরে গেলেন ১৩,৫৮৯ ভোটে।

আলিমুদ্দিনে সূর্যকান্ত মিশ্র। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

আলিমুদ্দিনে সূর্যকান্ত মিশ্র। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

সুমন ঘোষ
খড়্গপুর শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৬ ০৩:২৪
Share: Save:

অঙ্ক তাঁর সহায় ছিল না। তবু রণক্ষেত্র ছাড়েননি সেনাপতি। মাটি আঁকড়েই লড়াই চলেছিল।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভূমিপুত্রকে খালি হাতেই ফেরাল নারায়ণগড়। নিজের কেন্দ্রে বিরোধী দলনেতা এবং সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হেরে গেলেন ১৩,৫৮৯ ভোটে।

বৃহস্পতিবারের সকালটা অবশ্য ছিল অন্য রকম। গণনা শুরুর আগের মুহূর্ত পর্যন্তও চাঙ্গা ছিল বাম শিবির। খড়্গপুর কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে গণনা কেন্দ্রের কাছে ভিড় জমানো সিপিএম নেতা-কর্মীদের আশা ছিল— রাজ্যের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, সূর্যবাবু জিতবেনই। যেমন জিতেছিলেন পরিবর্তনের ভোটেও। কিন্তু গণনা যত এগোয়, ততই পিছিয়ে পড়তে থাকেন সূর্যবাবু। দিনের শেষে তাই বাম শিবিরে শুধুই হতাশা। উদ্বিগ্ন জেলা নেতারা বলছেন, ‘‘এ বার লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে গেল। সূর্যবাবুর জেতাটা ভীষণ জরুরি ছিল!”

জেতার অঙ্ক অবশ্য ভয়ঙ্কর কঠিনই ছিল সূর্যবাবুর। নারায়ণগড় থেকে ২০১১-র ঝড়েও তিনি প্রায় ৭ হাজার ভোটে জিতলেও পরের নির্বাচনগুলিতে এই কেন্দ্রে ধরাশায়ী হয় বামেরা। ২০১৩-র পঞ্চায়েতে এখানে তৃণমূল এগিয়ে ছিল প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার ভোটে। আর ২০১৪-র লোকসভায় সেই ‘লিড’ বেড়ে হয় প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার। এ বার বিধানসভায় অবশ্য যাদবপুর কেন্দ্রে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সূর্যবাবুকে। কিন্তু রাজ্য সম্পাদক ঠিক করেছিলেন, লড়তেই যখন হবে, নিজের পুরনো কেন্দ্রেই লড়বেন। ভোট-যুদ্ধে দলের সেনাপতি হয়েও প্রচারে সময় বার করে ছুটে এসেছিলেন নারায়ণগড়ে। সেই পর্বে মিছিলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা, তৃণমূলের হুমকি উপেক্ষা করে মানুষের সভায় আসার দৃশ্য বাম কর্মীদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার উপরে তাঁদের আস্থা ছিল মানুষের জোটে। ভোটের দিনও বুথ থেকে বুথ ছুটে মানুষের পাশে থাকার
বার্তা দিয়েছিলেন সূর্যবাবু নিজে। কিন্তু এত সবের পরেও সেনাপতির গড়রক্ষা হল না!

কিন্তু কেন অধরা থেকে গেল জয়?

জেলার সিপিএম নেতারা প্রাথমিক ভাবে দু’টি কারণ খুঁজে পেয়েছেন— ১) সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং ২) গরিব খেটে খাওয়া মানুষের একাটা অংশের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। সিপিএমের নারায়ণগড় জোনাল কমিটির সম্পাদক মদন বসুর কথায়, “বুথে গেলেও সকলে স্নায়ুর চাপ নিতে পারেননি। ভয়ে ওদেরই (তৃণমূল) ভোট দিয়েছেন। তবে এ বার মধ্যবিত্তদের একাংশের ভোট আমরা পেয়েছি। তাই গত লোকসভার থেকে ভোটটা কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু গরিবদের একাংশের ভোট আমরা পাইনি।” ফলের বিস্তারিত তথ্য হাতে এলে বুথ ধরে ধরে হারের কারণ খতিয়ে দেখা হবে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক তরুণ রায় বলেন, “কেন মানুষ আমাদের দিক থেকে মুখ ফেরাল, তা তো খতিয়ে দেখতেই হবে। এ ক্ষেত্রে নারায়ণগড় নিশ্চয়ই বেশি গুরুত্ব পাবে।”

দলের রাজ্য দফতরে থেকে গোটা রাজ্যের পরিস্থি্তিতে নজর রাখবেন বলে এ দিন জেলায় আসেননি সূর্যবাবু। কলকাতায় থেকেই দফায় দফায় খবর পেয়েছেন। তবে সাত সকালেই গণনাকেন্দ্রে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক তরুণ রায়, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হরেকৃষ্ণ সামন্ত থেকে জেলা ও জোনাল স্তরের নেতারা। রাজ্য জুড়ে জোট প্রার্থীদের হারের খবর আসা শুরু করতেই তাঁদের মুখ ম্লান হয়েছে। সেই সঙ্গে দলের রাজ্য সম্পাদক প্রথম রাউন্ড থেকে পিছিয়ে পড়ার খবরে বেড়েছে উদ্বেগ। পাশাপাশি চলে কাঁটাছেঁড়া— তবে কি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নারায়ণগড়ের সভায় গিয়ে ‘যা চাইবেন, তা-ই দেব’ প্রতিশ্রুতি দেওয়াতেই মানুষের মন পাল্টে গেল! কিন্তু সে তো সবংয়েও মুখ্যমন্ত্রী ‘দাদা’কে (মানস ভুঁইয়া) হারানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেখানে তো মানসবাবুই জিতেছেন। কর্মীদের কেউ কেউ আবার ভুল ভাঙালেন, ‘‘মানস ভুঁইয়া তো সবং অন্ত প্রাণ। সব সময় এলাকায় পড়ে থাকেন। কিন্তু সূর্য মিশ্রকে বছরভর এলাকার মানুষ পাননি।’’ তা ছাড়া, নারায়ণগড়ে তৃণমূলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বকেও কাজে লাগাতে পারেনি সিপিএম।

যুদ্ধ শেষে তাই চওড়া হাসি নারায়ণগড়ের তৃণমূল প্রার্থী প্রদ্যোত ঘোষের মুখে। তাঁকে কাঁধে নিয়ে আবির মাখিয়ে তৃণমূল কর্মীদের নাচও হল এক প্রস্ত। তারই ফাঁকে প্রদ্যোতবাবু বললেন, “একটা খুনি, সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী দলের মাথাকে হারিয়েছি! বাড়তি আনন্দ তো হবেই!”

আর খোদ সূর্যবাবু পরাজয়ে অবিচল থাকারই চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘পরাজয়টা পরাজয়ই। নারায়ণগড়ে পরাজয় আর রাজ্যে পরাজয় আলাদা নয়। মানুষ যা রায় দিয়েছেন, মেনে নিচ্ছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE