সাঁইত্রিশেই শেষ নয়। বাকি আছে আরও! নির্বাচন কমিশনের তরফে এ হেন আভাস পেয়ে থরহরিকম্প রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন। অপসারণের পরের তালিকায় কার বা কাদের নাম রয়েছে, সেই চিন্তায় কর্তাদের ঘুম ছুটেছে।
‘নিরপেক্ষতা’ ও ‘দক্ষতা’ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে কমিশন বৃহস্পতিবার রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসনের ৩৭ জন অফিসারকে সরিয়ে দিয়েছে। এঁদের মধ্যে একাধিক জেলাশাসক, পুলিশ সুপার থেকে শুরু করে থানার ওসি পদমর্যাদার অফিসারও আছেন। জানা গিয়েছে, আরও কয়েক জনের ভাগ্য কমিশনের সিদ্ধান্তের সুতোয় ঝুলছে। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা বেজায় চাপে।
এবং কমিশন সূত্রের ইঙ্গিত, পরের তালিকাও বেশ লম্বা হতে পারে। আরও কিছু ডিএম-এসপি তো বটেই, এমনকী কলকাতা পুলিশের জনা দুয়েক মাথাকেও অপসারণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। উপরন্তু যে পদ্ধতিতে কমিশন এ বার অফিসার সরাচ্ছে, তা-ও নজিরবিহীন।
কী রকম? নবান্নের খবর: গত ১৫ মার্চ কমিশনের ফুল বেঞ্চ এসে রাজ্যের মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বরাষ্ট্র-সচিব মলয় দে-কে জানিয়েছিল, বেশ কিছু অফিসার নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করছেন না। এ জন্য কাদের দায়িত্ব থেকে সরানো হতে পারে, নবান্ন-কর্তাদের সে ইঙ্গিতও দিয়েছিল কমিশনের ফুল বেঞ্চ। বেঞ্চ ফিরে গেলে রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি সংশ্লিষ্ট এসপি’দের তা আগাম জানিয়েও রেখেছিলেন
যেমন কথা, তেমন কাজ। বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যে এমন বেশ কয়েক জন অফিসারের নাম করে তাঁদের সরানোর জন্য দিল্লির নির্বাচন সদন থেকে রাজ্য প্রশাসনের সদরে বার্তা চলে আসে। বলা হয়, সন্ধের পরে কমিশন লিখিত নির্দেশিকা জারি করবে। সেই মতো নবান্নের কর্তারা রাত পর্যন্ত অফিসে থেকে গিয়েছিলেন। ‘‘ভোটের মুখে অফিসারদের বিষয়ে এ রকম তৎপরতা কমিশন আগে দেখিয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না!’’— মন্তব্য নবান্নের এক কর্তার।
‘বেনজির তৎপরতা’র এখানেই শেষ নয়। সরকারি সূত্রের খবর: কোনও অফিসারকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় নতুন কাকে বসানো হবে, সে ব্যাপারে এত দিন রাজ্যের কাছে নাম চেয়ে পাঠাত কমিশন। রাজ্যের পাঠানো তালিকা থেকে নতুন অফিসার বেছে নেওয়া হতো। কিন্তু এ বার নির্বাচন সদন রাজ্যের কাছে কোনও নাম চায়নি। তারা নিজেই ঠিক করেছে, অপসারিত অফিসারদের জায়গায় কারা আসবেন। তাঁদের নামও কমিশন পত্রপাঠ রাজ্যকে জানিয়ে দিয়েছে। কমিশন-সূত্রের দাবি— অতীত রেকর্ড, নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা যাচাই করে দায়িত্বে নতুন লোক আনা হয়েছে। ঠিক যে মাপকাঠিতে ফেলে ঠিক করা হয়েছে, কারা ভোটের সময়ে পদে থাকার যোগ্য নন।
উদাহরণ হিসেবে উঠে আসছে সঞ্জয় বনসলের নাম। হুগলির ডিএম বনসলকে বৃহস্পতিবার কমিশন সরিয়েছে। যার নেপথ্য কারণ সম্পর্কে নবান্নের এক কর্তার পর্যবেক্ষণ, ‘‘২০১৪-র লোকসভা ভোটের সময়ে বনসল ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার ডিএম। তাঁর বাংলোয় এক মন্ত্রী আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। সম্ভবত এরই জেরে ওঁকে সরতে হল।’’ বনসল অবশ্য বদলির কারণ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি।
বনসলের মতো সরতে হয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুরের এসপি অর্ণব ঘোষকে, বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দা-প্রধান থাকাকালীন সারদা-মামলায় যাঁর ভূমিকা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন মজুত। এসপি হিসেবেও ওঁর নিরপেক্ষতা সম্পর্কে অভিযোগ আছে। অর্ণববাবুর অপসারণের পিছনে এই প্রেক্ষাপটকে রাখছে নবান্নের একাংশ। শুক্রবার এ প্রসঙ্গে অর্ণববাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘কথা বলতে পারব না।’’
একই ভাবে ‘নিরপেক্ষতা’র মানদণ্ডে উতরোতে না-পেরে মালদহের এসপি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরতে হয়েছে বলে প্রশাসনিক মহলের অভিমত। সূত্রের খবর: বিধানসভা ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মালদহ সফরে গিয়েছিলেন। প্রসূনবাবু তখন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন। শেষমেশ তাঁর চেষ্টা সফল না হলেও কমিশনের কানে খবর ঠিক পৌঁছে গিয়েছে। পাশাপাশি কমিশন জানতে পেরেছে, কালিয়াচক-সহ মালদহের নানা জায়গায় পর পর রাজনৈতিক গোলমালে এসপি’র ভূমিকা যথেষ্ট নিরপেক্ষ ছিল না।
অতএব, প্রসূনেরও চেয়ার গিয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে প্রসূনবাবুও এ দিন কিছু বলতে চাননি। পদ খোয়ানো অন্য অফিসারেরাও মুখ্যমন্ত্রীর ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে প্রশাসনিক মহলে পরিচিত। ‘‘স্বভাবতই কমিশন ওঁদের দিয়ে ভোট করাতে চায় না।’’— বলছেন নবান্নের এক আধিকারিক।
আর ওঁদের জায়গায় যাঁদের আনা হয়েছে, সেই সব অফিসারের কয়েক জনকে ২০১৪-র ভোটেও কমিশন কাজে লাগিয়েছিল। যেমন ১৯৯৮ ব্যাচের আইএএস নারায়ণস্বরূপ নিগমকে বাছাই করে কমিশন বুঝিয়ে দিয়েছে, জঙ্গলমহলের কঠিন সময়ে সেখানে ওঁর নেতৃত্বে যে ভাবে সুষ্ঠু ভোট হয়েছিল, সেটা তাদের বিলক্ষণ স্মরণে আছে। উল্লেখ্য, রাজ্য সরকার যাঁদের তুলনায় কম গুরুত্বের পদে রেখেছিল, কমিশন বেছে বেছে তেমনই বেশ কিছু অফিসারের হাতে ভোটের বড় দায়িত্ব চাপিয়েছে।
এ তো গেল উঁচু দরের অফিসারদের কথা। বিভিন্ন থানার ২৪ জন আইসি, ওসি-কেও সরানো হয়েছে। এটা হয়েছে মূলত গোয়েন্দা-তথ্যের ভিত্তিতে। নিচুতলার ওই অফিসারদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, তাঁরা শাসকদলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করছিলেন। স্থানীয় নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে তাঁরা থানা চালাতেন। এমনকী, বাগুইআটি থানার আইসি’র নামে তো তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার নালিশও মিলেছে! কমিশনের মতে, স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা খুনের তদন্তে ওঁর ভূমিকা যথাযথ ছিল না।
অপসারণের পালায় যে এখানেই দাঁড়ি পড়ছে না, সে ইঙ্গিতও রয়েছে জোরদার। কমিশন-সূত্রের খবর, রাজ্যের আরও কিছু অফিসারের কাজকর্মে কড়া নজর রেখেছেন খোদ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। পাঁচ রাজ্যের সিইও-রা পশ্চিমবঙ্গ সফর সেরে দিল্লি ফিরলে আর এক দফা ওলটপালট হতে পারে। সম্ভাব্য পরবর্তী তালিকায় অন্তত তিন ডিএম ও চার এসপি’র নাম থাকার সম্ভাবনা। এমনকী, কলকাতা পুলিশে মাথাবদল হওয়াও অসম্ভব নয় বলে কমিশন সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy