হিসেবনিকেশ। আজ মিলবে কার অঙ্ক?
সম্ভাবনা ১
১৭০-র বা তার বেশি আসন জিতে একক বৃহত্তম দল হিসাবে নির্বাচিত হবে তৃণমূল কংগ্রেস। স্বস্তিজনক জয় হবে দিদির। চড়াম চড়াম ঢাকের আওয়াজে কান পাতা দায় হবে। সরকারের স্থায়িত্ব ও স্থিরতা নিয়ে তখন আশু কোনও আশঙ্কা থাকবে না। সদিচ্ছা থাকলে সে ক্ষেত্রে নয়া মন্ত্রিসভা সারদা-নারদার সংক্রমণমুক্ত রাখার ঝুঁকি নিতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুর্নীতি, তোলাবাজি, জুলুম, শিল্পে বন্ধ্যত্ব, সিন্ডিকেট-রাজের যে কালো দাগ লেগেছে তাঁর দলের গায়ে, এ হেন জয় সেই দাগ মুছে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি গড়ার সুযোগও এনে দিতে পারে।
দলে দিদির কর্তৃত্ব নিয়ে কোনও সমস্যা না থাকারই কথা। তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ রসায়ন নিয়ে তাই কৌতূহল থাকবে। হতে পারে সংগঠন ও সরকারে তখন নতুন মুখ তুলে আনতে পারেন দিদি।
শাসক দলের এহেন জয়ে বার্তা থাকবে বিরোধীদের উদ্দেশেও। তা এই যে, পরস্পরের হাত ধরে বাম ও কংগ্রেস নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে পারলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের প্রতি এখনও বাংলার বহু মানুষের আস্থার ঘাটতি রয়েছে। কিছুটা অক্সিজেন পেলেও আরও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে তাঁদের। গত পাঁচ বছরে বিধানসভায় বিরোধীদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল না। শত অনিয়ম করেও তাই কার্যত পার পেয়ে গিয়েছে সরকার। জোট গড়ে ভোটে লড়ার পর বিধানসভায় ঐক্যবদ্ধ ভাবে গঠনমূলক বিরোধীর ভূমিকা পালনের চ্যালেঞ্জ থাকবে বাম-কংগ্রেসের সামনে।
সম্ভাবনা ২
একক বৃহত্তম দল হিসাবে নির্বাচিত হলেও তৃণমূলের আসন সংখ্যা কমবেশি দেড়শো ছাড়াবে না। খাতায় কলমে সেই জয় বাস্তবের রাজনীতিতে পরাজয়েরই সামিল। বুঝতে হবে, জনতা রায় দিয়েছে মোটামুটি ভাবে দিদির বিরুদ্ধেই। সারদা-নারদা-গুড়ের বাতাসার গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষ। তবে ভোটের নানা জটিল অঙ্কে হারতে হারতে খাদের ধারে এসে টিকে গেল দিদির দল।
খাদের ধারে দাঁড়ালে প্রতি মুহূর্তে বিপদের আশঙ্কা থাকে। এমন পরিস্থিতি হলে দিদিকে সরকার ও দল চালাতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খেতে হতে পারে। বিশেষ করে মন্ত্রিসভা গঠন করতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা হতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নারদ কাণ্ডে অভিযুক্তদের তখন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। আবার তা করলেও বিধানসভায় বিরোধীরা রে রে করে উঠবেন। সেই অস্থির পরিস্থিতিতে রাজ্যে সুশাসন কায়েম রাখা এক প্রকার দুরূহ ব্যাপার। আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে শিল্প সম্ভাবনার ক্ষেত্রে আরও করুণ দশা হতে পারে রাজ্যের। আরও পিছিয়ে যেতে পারে বাংলা।
মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, সুব্রত মুখোপাধ্যায়রা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও, তৃণমূল সূত্রের মতে তলে তলে দিদিকে এমনই দুর্বল দেখতে চাইছেন তাঁরা। এমনিতেই গোষ্ঠী রাজনীতিতে জেরবার তৃণমূল। এমন পরিস্থিতি হলে দলের মধ্যেই দিদির কতৃর্ত্ব নড়বড়ে হবে, তাই কাউকে চটানোর ঝুঁকি নিতে পারবেন না মমতা। সেই সুযোগ নেওয়ার সব রকম চেষ্টা করতে পারেন বিরোধীরা। যার ফলে গোড়ার দিন থেকেই সরকারের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে থাকবে।
সম্ভাবনা ৩
১৪৭টির বেশি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে বাম-কংগ্রেস জোট। বাংলার মাটিতে এক অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখানো হবে। ঐতিহাসিক ভাবে বিপরীত মেরুতে থাকা দু’দল জোট বেঁধে সরকার গঠন করবে। তাই মন্ত্রিসভা গঠনের সমীকরণ কী হবে, শুরুতে কৌতূহল থাকবে তার ওপর। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র নারায়ণগড় আসন থেকে জিতলে সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী নিয়ে জল্পনার অবসান তখনই হয়ে যাবে। কিন্তু জোট জিতলেও তিনি যদি না-জেতেন তখন মুখ্যমন্ত্রী মনোনীত করা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। উপমুখ্যমন্ত্রী পদের দাবি অনিবার্য ভাবেই করবে কংগ্রেস। এমনকী বাম-কংগ্রেসের আসনসংখ্যার মধ্যে খুব বেশি ফারাক না-থাকলে মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়েও দর কষাকষি শুরু হতে পারে। দর কষাকষি হবে গুরুত্বপূর্ণ সব দফতর নিয়েও। সেই জট ছাড়াতে রাহুল-ইয়েচুরির স্তরে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তা ছাড়া ভিন্ন মেরুতে থাকা দুই দলের কাছে জোটবদ্ধ ভাবে সরকার চালানোটা কম চ্যালেঞ্জের নয়। তাঁদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা থাকবে অনেক। শিল্পে বন্ধ্যত্ব কাটাতে হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে। সে সবেরও আগে রাজ্যে আইনের শাসন কায়েম করে তোলাবাজির জুলুম, সিন্ডিকেট-রাজ বন্ধ করার চ্যালেঞ্জ থাকবে তাঁদের সামনে। এমন পরিস্থিতিতে তৃণমূলের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। এক সময় কংগ্রেসের রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল। জোট এ বার সরকার গঠনে সফল হলে বুঝতে হবে অনেক দিন পর কংগ্রেস লড়াইয়ে ফিরেছে। রাজ্য রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার দশা কাটিয়ে অনিবার্য হয়ে উঠেছে তারা। তখন তৃণমূল ছেড়ে ফের কংগ্রেসের ফেরার একটা ঝোঁক তৈরি হতে পারে দিদির দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
সংখ্যা-গুরুদের মতে, আজ গণনার পর পরিষ্কার হয়ে যাবে আরও একটা বিষয়। দিদির পক্ষে খাঁটি ভোট ঠিক কত? ২০১১ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে লড়েছিলেন দিদি। আলাদা করে তৃণমূলের ভোট শতাংশ তখন জানা তাই সম্ভব ছিল না। পরবর্তী কালে পঞ্চায়েত, পুরভোট, লোকসভা নির্বাচনে দিদির ভাইরা ভোট মেশিনে এত বালতি বালতি জল ঢেলেছেন যে তৃণমূলের প্রকৃত ভোট শতাংশ তথা জনভিত্তি তখনও বোঝা যায়নি। এ বারও স্থান বিশেষে জল মেশানোর চেষ্টা হয়েছে। তবে খুব বেশি সম্ভব হয়নি। তাই তৃণমূলের প্রকৃত শক্তি কতটা এ বার তার একটা স্পষ্ট সংখ্যা জানা যেতে পারে। বোঝা যাবে, দুধ কত, জলই বা কত ছিল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy