Advertisement
২৫ মে ২০২৪

ক্লাবের মাঠ চাই, বন্ধ তাই স্কুলের রাস্তা

দাসপুরের শ্রীবরা গ্রামের তৃণমূল পুষ্ট ক্লাব ‘নবজাগরণ সঙ্ঘ’-এর মাঠ বানানোর জন্য তাই রীতিমতো গা-জোয়ারি চলছিল। পাশের শ্রীবরা বালিকা বিদ্যালয়ে যাওয়ার রাস্তা বন্ধের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। মাটির ওই রাস্তা শক্তপোক্ত করতে দু’পাশে বসানো টালি রাতারাতি খুলে ফেলা হচ্ছিল। সরকারি অনুমতি না নিয়ে পাশের জলাশয় ভরাটের তোড়জোড়ও চলছিল।

স্কুলে (চিহ্নিত) যাওয়ার এই রাস্তা আটকেই মাঠ সম্প্রসারণ করা হচ্ছিল। জল তুলে ফেলা হয়েছে রাস্তার দু’পাশের পুকুর থেকে। এই ক্লাবের বিরুদ্ধেই উঠছে অভিযোগ (ডান দিকে)। ছবি: কৌশিক সাঁতরা।

স্কুলে (চিহ্নিত) যাওয়ার এই রাস্তা আটকেই মাঠ সম্প্রসারণ করা হচ্ছিল। জল তুলে ফেলা হয়েছে রাস্তার দু’পাশের পুকুর থেকে। এই ক্লাবের বিরুদ্ধেই উঠছে অভিযোগ (ডান দিকে)। ছবি: কৌশিক সাঁতরা।

অভিজিৎ চক্রবর্তী
দাসপুর শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০১:২৬
Share: Save:

দাসপুরের শ্রীবরা গ্রামের তৃণমূল পুষ্ট ক্লাব ‘নবজাগরণ সঙ্ঘ’-এর মাঠ বানানোর জন্য তাই রীতিমতো গা-জোয়ারি চলছিল। পাশের শ্রীবরা বালিকা বিদ্যালয়ে যাওয়ার রাস্তা বন্ধের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। মাটির ওই রাস্তা শক্তপোক্ত করতে দু’পাশে বসানো টালি রাতারাতি খুলে ফেলা হচ্ছিল। সরকারি অনুমতি না নিয়ে পাশের জলাশয় ভরাটের তোড়জোড়ও চলছিল।

নিরুপায় স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। প্রশাসনের হস্তক্ষেপেই আপাতত সেই দাদাগিরিতে দাঁড়ি পড়েছে। বন্ধ হয়েছে কাজ। কিন্তু তবু স্বস্তি নেই। কারণ, ক্লাবের দাদারা যে মাঠ বানাতে মরিয়া! ওই ক্লাবের সভাপতি ভরত মণ্ডল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন, “কাজ একদিন না একদিন শুরু হবেই। রাস্তাও বন্ধ হবে। আমাদের জায়গায় আমরা যা খুশি তাই করতে পারি।’’

দাসপুর-২ ব্লকের দুধকোমরা পঞ্চায়েত এলাকায় পড়ে ষাট ছুঁই ছুঁই শ্রীবরা বালিকা বিদ্যালয়। গোপীগঞ্জ পেরিয়ে রূপনারায়ণের বাঁধ বরাবর যেতেই পড়ে ওই স্কুলটি। বাঁধের রাস্তা থেকে নেমে টালি দিয়ে ঘেরা দেড়শো মিটার দীর্ঘ মাটির রাস্তা পেরিয়ে স্কুলের প্রধান ফটকে পৌঁছতে হয়। ১৯৫৭ সালে স্কুল তৈরির অনেক আগে থেকেই রয়েছে ওই রাস্তাটি। আর তাকে ঘিরেই বিতর্ক।

মঙ্গলবার এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, স্কুলের ঠিক উল্টো দিকে ক্লাব। স্কুলে যাওয়ার রাস্তার দু’পাশে একাধিক জলাশয়ও আছে। ক্লাব সদস্যদের দাবি, সম্প্রতি স্থানীয় এক বাসিন্দার থেকে ওই রাস্তা-সহ মোট ১১ কাঠা জমি কেনার জন্য তাঁরা অগ্রিম টাকা দিয়েছেন। কিন্তু সেই সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে পারেননি ক্লাব সদস্যরা। ফলে, ওই জমি আদৌ তাঁদের কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, জমি কেনা দূর, অনুমতি ছাড়াই জলাশয় ভরাটের কাজ শুরু করেছিল ক্লাবের ছেলেরা। একটি জলাশয়ের জল ছাঁচা হচ্ছিল। পাশাপাশি খোলা হচ্ছিল রাস্তার টালি। ক্লাব কর্তৃপক্ষের অবশ্য সাফাই, স্কুলে যাওয়ার জন্য নতুন রাস্তা তাঁরা তৈরি করে দেবেন। সে কথা স্কুলকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ তা মানতে নারাজ। স্কুলের টিচার ইন-চার্জ চন্দনা ঢালি সরকার অবশ্য বলেন, “রাস্তাটির স্থান পরিবর্তন হবে বলে আমাদের জানিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু আমরা কোনও সম্মতি দিইনি।” ওই স্কুলটির পরিচালন সমিতিতেও ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল। তবে স্থানীয় তৃণমূল নেতা তথা স্কুল পরিচালন কমিটির সভাপতি পলাশকান্তি বেরারও বক্তব্য, “আমাদের না জানিয়েই জমি কেনার কথা হচ্ছিল। তবে জমি এখনও রেজেস্ট্রিও হয়নি। আমরা বিষয়টি মেনে নিতে না পেরে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়।”

স্কুলের পাশে রয়েছে গোটা গ্রাম। প্রকাশ্যে কেউ কিছু না বললেও ক্লাবের এই ‘দাদাগিরি’ মানতে পারেননি অনেকেই। গ্রামের বাসিন্দা তথা ওই স্কুলের অভিভাবক জয়দেব মাঝি বলেন, “রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে মেয়েদের তো আর স্কুলে যাওয়াই হবে না। গোটা ঘটনায় গ্রামের বদনাম হল।”

পরিস্থিতি বেগতি দেখে শাসক দলের স্থানীয় নেতারাও ক্লাবের বিরুদ্ধেই মুখ খুলছেন। তৃণমূল পরিচালিত স্থানীয় দুধকোমরা পঞ্চায়েতের প্রধান সরস্বতী দাস বলেন, “রাস্তাটি স্কুলের ছাত্রীদের জন্য। সরকারি ভাবেই তার সংস্কার হয়। ফলে, অনুমতি না নিয়ে কী ভাবে ক্লাব ওই রাস্তা বন্ধ করছিল তার তদন্ত হবে।” ক্লাবের মাঠের জন্য স্কুলের রাস্তা বন্ধ সমর্থন করছেন না পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ তৃণমূলের শ্যাম পাত্রও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ক্লাব সদস্য অবশ্য বলছেন, “শাসক দলের স্থানীয় নেতারা সায় দিয়েছিলেন বলেই কাজ শুরু করেছিলাম। এখন পরিস্থিতি গরম দেখে নেতারা পিছু হটছেন।”

প্রশাসন অবশ্য স্কুলের পাশে দাঁড়িয়েছে। ঘাটালের মহকুমাশাসক পিনাকিরঞ্জন প্রধান জানান, সোমবার স্কুলের কাছ থেকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানার পরে মঙ্গলবারই কাজ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই ক্লাবকে। পুরো বিষয়টি তদন্ত করে বিডিও-কে রিপোর্ট দিতেও বলা হয়েছে।

‘দিদি’র ভাইরা অবশ্য এতে দমে যাচ্ছে না। ক্লাবের সভাপতি ভরত মণ্ডলের সাফ কথা, “আমরা তো নতুন রাস্তা আমাদের টাকাতেই করে দিতাম। তাহলে এতে সমস্যার কী আছে!” তাই বলে অনুমতি ছাড়া পুকুর ভরাটও করে দেবেন? এ বার ভরতের জবাব, “কত জলাশয়ই তো ভরাট হচ্ছে। সব কি অনুমতি নিয়ে হচ্ছে?”

আর এতেই প্রমাদ গুনছেন শ্রীবরা গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁদের আশঙ্কা, সব কিছু একটু থিতোলেই হয়তে ফের শুরু হবে দাদাগিরি। মাঠ বানাতে যা নয় তাই করবে ‘দিদি’র ভাইসকল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 school club
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE