Advertisement
E-Paper

নেত্রীর বাণে ঘায়েল ভাইয়েরা খেপে লাল

পাড়ার কাকিমা-জেঠিমার কানে কানে বললে তবু কথা ছিল! তেমাথার মোড়ে এক্কেবারে মাইক হাতে নিয়ে কাঁদুনি গেয়ে এসেছেন। ভাইদের আর ইজ্জত থাকে? এর পর লোকে চোর বলবে না! আর ভোট দেবে? দিদি বাড়ি ঢোকার আগেই তাই শুরু ফোনাফুনি। কেউ ফোন করলেন মমতাকে।

শঙ্খদীপ দাস

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:২৯
পান্ডুয়ার সভায় মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার তাপস ঘোষের তোলা ছবি।

পান্ডুয়ার সভায় মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার তাপস ঘোষের তোলা ছবি।

পাড়ার কাকিমা-জেঠিমার কানে কানে বললে তবু কথা ছিল! তেমাথার মোড়ে এক্কেবারে মাইক হাতে নিয়ে কাঁদুনি গেয়ে এসেছেন। ভাইদের আর ইজ্জত থাকে? এর পর লোকে চোর বলবে না! আর ভোট দেবে? দিদি বাড়ি ঢোকার আগেই তাই শুরু ফোনাফুনি। কেউ ফোন করলেন মমতাকে। মমতা নিজেই কাউকে কাউকে। ফোনেই শুরু হয়ে গেল হাত-পা ছুড়ে কান্নাকাটি। কেউ কেউ আবার রাগে গলা ভারী করে চোটপাট করলেন খোদ মমতার উপরেই। অমনি ডিগবাজি দিদির— আরে ও কিছু না রে, একটা লাইন মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে! আর তা নিয়েই যত্তসব হইচই। দ্যাখ কী পাজি!

কিন্তু রবিবার মুখ ফস্কেই যদি বলে ফেলেন, সোমবার কই শুধরে নিলেন না তো!

সুতরাং মুষল পর্ব শুরু হয়ে গেল সংসারে। এমনিতেই দিদির দলে অবিশ্বাস ছায়া ফেলেছে অনেক দিন। গত লোকসভা ভোটের মুখে নারদ নিউজের গোপন ক্যামেরায় তোলা ছবিতে দেখা গিয়েছে টিকিট বিলি প্রসঙ্গে ফিরহাদ (ববি) হাকিম বলেছেন, ‘‘দিদি শালা ক্ষেপে গেল। মুকুল পেয়েছেটা কী! পার্টিটা কি বিক্রি করে দিচ্ছে?’’ সেই ভাইরা এ বার দেখছেন, বিপদে পড়লে দিদিই তাঁদের ঝেড়ে ফেলতে দ্বিধা করছেন না।

রবি সন্ধ্যায় বৌবাজারে সভা ছিল তৃণমূলের। সেখানে খোলা মঞ্চ থেকে দিদি বলেছিলেন, আগে জানলে নারদ-অভিযুক্তদের টিকিটই দিতেন না তিনি। নারদ ফুটেজ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কথা দাবানলের মতো ছড়ায়। কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, দিদির কাছে ব্যাপারটা এখন ‘আপনি বাঁচলে ভাইয়ের নামের’ মতোই হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিদি বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন, সারদা, নারদ, উড়ালপুল, গুড়-বাতাসা মিলেমিশে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে ভবানীপুরও হয়তো এখন নিরাপদ নয়। নিজের কেন্দ্র বাঁচাতে তাই ভাইদের পথে বসাতেও দু’বার ভাবছেন না তিনি।

মমতার মন্তব্যের পরে ভোটে দাঁড়ানো চার নেতাকে, যাঁদের নারদ ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, ফোন করা হয় আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে। কিন্তু কেউই মুখ খোলেননি। সুব্রত মুখোপাধ্যায় তো এক কদম এগিয়ে বলেন, ‘‘এর থেকেও মারাত্মক কথা বললেও কিছু বলব না।’’ কিন্তু ঘটনা হল, আনন্দবাজারের ফোন নামিয়ে রেখেই মমতাকে ফোন করেন সুব্রতবাবু। তৃণমূল সূত্রের খবর, মমতাকে তিনি বলেন, এর পর আর ভোটে লড়ার কী প্রয়োজন? কারণ মমতাই তো হারিয়ে দিলেন! উষ্মার গন্ধ পেতে দেরি হয়নি মমতার। দেরি হয়নি ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টায় নেমে পড়তেও। একে একে শুভেন্দু অধিকারী, শোভন চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিমকে ফোন করেন দিদি। বোঝানোর চেষ্টা করেন, তিনি এমন কিছুই বলেননি। একটি লাইন শুধু ‘স্লিপ অব টাং’ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলের অন্দরের খবর, এ কথায় চিঁড়ে ভেজেনি। শুভেন্দু তাঁকে বলেন, ‘এটা কী করলেন আপনি? একটা মরা ইস্যুকে জ্যান্ত করে দিলেন!’ তার পর দিদিকে সতর্ক করে দিয়ে শুভেন্দু বলেন, নন্দীগ্রামে তাঁর কোনও অসুবিধা হবে না। কিন্তু মমতা যা বলেছেন, তাতে কলকাতার সবাইকে ঠ্যালা বুঝতে হবে। তখন বাবা-বাছা করে দিদি তাঁকে বোঝান, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। নারদ নিয়ে সংবাদমাধ্যম প্রশ্ন করলে এখন থেকে সবাই যেন মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন।

সেই কুলুপ অবশ্য এঁটে ফেলেছেন সকলেই। শোভন যেমন এ দিন বলেন, ‘‘আমি তৃণমূলের অনুগত সৈনিক, কোনও মন্তব্য করব না।’’ শুভেন্দুর মন্তব্য, ‘‘দিদির সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি প্রশ্নই নেই। মিডিয়া নয়কে হয় করতে চাইছে।’’ সুব্রতবাবু আনন্দবাজারের ফোনই ধরেননি। তবে এবিপি আনন্দকে বলেছেন, ‘‘মমতার মন্তব্য নিয়ে যা ব্যাখ্যা দেওয়ার মমতাই দেবে।’’ আর ববি জানিয়েছেন, নতুন করে তাঁর আর কিছু বলার নেই।

কিন্তু তাই বলে ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেল, এমনটা মনে করার কোনও কারণই নেই, বলছে শাসক শিবির। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘সবাই বোকা নাকি! দিদি কিছুই মুখ ফস্কে বলেন না। একশো কিলোমিটার দূরের কথা ভেবে মুখ খোলেন।’’ নারদ-মন্তব্যের পিছনেও সেই অঙ্ক রয়েছে বলেই এই নেতার দাবি। ‘‘তা না হলে তো মুখ ফস্কে বেরনো কথা সোমবার হুগলি বা বর্ধমানের সভায় শুধরে নিতে পারতেন,’’ বলছেন তিনি। তাঁর মত সমর্থন করছেন শাসক দলের আর এক শীর্ষ নেতা। তাঁর মতে, ‘‘মমতা রবিবার যা বলার ভেবেচিন্তেই বলেছেন। দিদি জানেন, এ নিয়ে দলে অশান্তি হবে। শোভন-সুব্রত-ববিরা রাগ-অভিমান করবে। তাই ফোন করে ‘ওয়ান-টু-ওয়ান পুলটিশ’ দিয়েছেন। কিন্তু সে কথা মানুষ জানতে পারল কোথায়? ফলে কাজও হল, আবার খবর ছাপা হলে দরকারে তা অস্বীকারের পথ খোলাও রইল। এই হল টিপিক্যাল দিদি।’’

তৃণমূল সূত্র বলছে, মমতার নারদ-মন্তব্যের পিছনে আশু কারণ যদি হয় ভবানীপুর বাঁচানো, দূরের কারণ তা হলে ভোট-পরবর্তী ভাবনা। ভবানীপুরের পিচ সেই লোকসভা ভোট থেকেই গোলমেলে। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও সেখানে পরের পর ভোটে পিছিয়ে থেকেছে তৃণমূল। আর এখন দুর্নীতির প্রসঙ্গ সামনে এসে পড়ায় শহুরে মধ্যবিত্তদের উপরে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। ফলে দিদির জয় ষোলো আনা নিশ্চিত কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে তৃণমূলের অন্দরেই। ভবানীপুরে কিছু ভালমন্দ যদি হয়ে যায়, এবং আশপাশের কেন্দ্রে নারদ অভিযুক্তদের কেউ জিতে যান, মুখ থাকবে?

আর দূরের ভাবনা হল, শেষ পর্যন্ত সরকার গড়ার মতো সংখ্যা যদি হয়েই যায়! সে ক্ষেত্রে সুব্রত, ফিরহাদরা যদি জেতেন তা হলে তাঁদের ফের মন্ত্রী করার জন্য চাপ থাকবে। চাপ থাকবে লোকসভা থেকে বিধানসভায় নিয়ে আসা শুভেন্দুকেও মন্ত্রী করার। কিন্তু এঁদের মন্ত্রী করলে নারদ-বিতর্ক পিছু তো ছাড়বেই না, বরং আরও চেপে বসবে। তৃণমূল সূত্র বলছে, সম্ভবত এই সব সাত-সতেরো ভেবেই দিদি রবিবার গুগলি ছেড়েছেন।

তবে এর বাইরে আরও একটা বিষয় ভাবাচ্ছে শাসক শিবিরকে। দলের এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘মায়াবতী, জয়ললিতার মতো দিদিও কড়া হাতে দল চালান। তাঁর মুখের ওপর কেউ কোনও কথা বলেন না। গলা তোলেন না। কিন্তু রবিবারের পর তাও ঘটতে শুরু করে দিয়েছে। এর পর দিদির সংসার টিকবে তো!’’

TMC Mamata Banerjee assembly election 2016 MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy