Advertisement
E-Paper

সুনসান বুথে সকলই তেনাদের কেরামতি

দুপুর সাড়ে বারোটায় ৬৪ শতাংশ। আড়াইটেয় ৭৬ শতাংশ। বেলাশেষে ৮৮ শতাংশ। বন্যার জলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল ভোটের হার। স্থান, চক-হীরামণি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অথচ দুপুর সাড়ে বারোটাই হোক বা আড়াইটে, বুথে গিয়ে দেখেছি প্রিসাইডিং অফিসার আর জনা কয়েক সিআরপিএফ জওয়ান ছাড়া কাকপক্ষী নেই!

কিংশুক গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৩০
ভোটের দিনে ভূতের মার। দেখেও দেখল না কেন্দ্রীয় বাহিনী। সোমবার ঘাটালের বলরামগড়ে কৌশিক সাঁতরার তোলা ছবি।

ভোটের দিনে ভূতের মার। দেখেও দেখল না কেন্দ্রীয় বাহিনী। সোমবার ঘাটালের বলরামগড়ে কৌশিক সাঁতরার তোলা ছবি।

দুপুর সাড়ে বারোটায় ৬৪ শতাংশ। আড়াইটেয় ৭৬ শতাংশ। বেলাশেষে ৮৮ শতাংশ।

বন্যার জলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল ভোটের হার। স্থান, চক-হীরামণি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অথচ দুপুর সাড়ে বারোটাই হোক বা আড়াইটে, বুথে গিয়ে দেখেছি প্রিসাইডিং অফিসার আর জনা কয়েক সিআরপিএফ জওয়ান ছাড়া কাকপক্ষী নেই! কিন্তু ওঁরা হাসিমুখে বলেছেন, ভোট খুব ভাল হচ্ছে!

এমন ‘অদৃশ্য’ ভোটও হয়!

হয় হয়, ‌জ়ানতিও পারা যায়! আলপথ ধরে হনহন করে হেঁটে যেতে যেতে একদল আদিবাসী পুরুষ-মহিলা তো বলেই গেলেন, ‘আমাদের ভোট দিতে লাই’। ডেবরা বিধানসভার মলিঘাটিতে দেখা হয়েছিল ওঁদের সঙ্গে। চোখেমুখে ভয় দেখে জানতে চেয়েছিলাম, ‘তোমাদের ভোট কোথায়?’ তাতে এই জবাব এল। কয়েক জন সুর নামিয়ে যোগ করলেন, “তুমরাও যাও। আমাদের আর ঝামেলায় ফেলোনি বাপু।”

আগের সোমবার জঙ্গলমহলের ভোটে ভূতের নাচ দেখেছি। মাংস-ভাত, মুড়ির ঠোঙা থেকে চোখ রাঙানি, সব রকম অস্ত্র প্রয়োগ করে ভোটারদের বুথমুখো হওয়া আটকানো দেখেছি। কিন্তু আপাত ভাবে এক্কেবারে ঠান্ডা এলাকা ডেবরাতে এসেও যে এমন চোরা সন্ত্রাসের ছবি দেখতে হবে, ভাবিনি।

দুপুরে ডেবরা বিধানসভার ১৪২ নম্বর বুথ, চক-হীরামণি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েই ধাক্কাটা লেগেছিল। স্কুলবাড়ির প্রায় ৫০ মিটার আগে আমাকে আর আলোকচিত্রী কিংশুক আইচকে আটকে দিলেন এক জওয়ান। বাজখাঁই গলায় বললেন, ‘‘অন্দর জানা মানা হ্যায়।’’ অথচ নির্বাচন কমিশনের পরিচয়পত্র দেখিয়ে সকালেই বেশ ক’টি বুথে ঢোকার ছাড়পত্র মিলেছিল। তা হলে এই বুথে কেন একুশে আইন? জওয়ানের জবাব, ‘‘প্রিসাইডিং অফিসার কা মানা হ্যায়।’’

দমে না গিয়ে তক্কো জুড়লাম। জওয়ানটি এ বার বুথমুখো হাঁটা দিলেন। খানিক পরে ফিরে এসে বললেন, “ঠিক হ্যায় জাইয়ে। পর পোলিং স্টেশন কে অন্দর জানে কা পারমিশন নহি হ্যায়।”

বুথ চত্বরে গিয়ে চোখ কপালে উঠল। ভোটার কই? রোদের তাপ থেকে ভোটারদের বাঁচাতে স্কুলবাড়ির সামনে ত্রিপলের শামিয়ানা খাটানো হয়েছে। কিন্তু সেখানে এক জনও নেই। খাঁ-খাঁ বুথ চত্বরে চার জন জওয়ান শুধু ঘুরছেন। আমাদের দেখে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন প্রিসাইডিং অফিসার কবিশেখর মণ্ডল। কাঁথি থেকে আসা মানুষটি সাংবাদিক পরিচয় শুনে কিছুটা বিব্রত। ভোটার কোথায়? বুথ তো সুনসান! কবিবাবু আমতা আমতা করে বললেন, “সকালে লম্বা লাইন ছিল। দুপুরে লোকজন একটু কম।”

ভোটের হার কত? জবাব এল, ‘‘বেলা সাড়ে বারোটা পর্যন্ত ৬৪%।’’

আশপাশের এলাকা ঘুরে জানলাম— মনোহরপুর, শ্রীপুর, চক-হীরামণি ও জোতসুজা, মলিঘাটি পঞ্চায়েতের এই চারটি গ্রামের ভোটগ্রহণ কেন্দ্র এই স্কুল। রাস্তার দু’ধার জোড়াফুলে ছয়লাপ। গোলগ্রামে দেখা হয়েছিল সিপিএমের ডেবরা জোনাল সম্পাদক প্রাণকৃষ্ণ মণ্ডলের সঙ্গে। এই কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী জাহাঙ্গির করিমের ইলেকশন এজেন্ট প্রাণকৃষ্ণবাবু বলছিলেন, “আগের রাতে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ধমকে এসেছে তৃণমূলের বাহিনী। লোকজন কোন ভরসায় ভোট দিতে যাবে বলুন তো?”

প্রাণকৃষ্ণবাবু আরও জানালেন, চক-হীরামণি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতোই মলিঘাটি অঞ্চলের অন্য সাতটি বুথেও সিপিএমের পোলিং এজেন্টকে বসতে দেওয়া হয়নি। সব ভূতের ভোট হচ্ছে। এ সব অভিযোগ অবশ্য মানলেন না তৃণমূল প্রার্থী সেলিমা খাতুন (বিবি)। হাসিমুখে বললেন, “আমি তো সারাদিন এলাকায় ঘুরলাম। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভোট দিয়েছেন। কোথাও কোনও অসঙ্গতি চোখে পড়েনি।”

সত্যি?

দুপুর আড়াইটে নাগাদ ফের এলাম চক হীরামণি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দু’ঘণ্টা বাদেও সেই খাঁ-খাঁ ছবি। ফারাক বলতে তাপ থেকে বাঁচতে জওয়ানরা গামছায় মুখ ঢেকেছেন। ফের আমাদের দেখে হাসি হাসি মুখে প্রিসাইডিং অফিসার কবিবাবু বললেন, ‘‘ভাল ভোট পড়ছে। এই তো আড়াইটের মধ্যে প্রায় ৭৬ শতাংশ ভোট পড়ে গিয়েছে।’’

লোক নেই, অথচ লাফিয়ে লাফিয়ে ভোটের হার বাড়ছে কী করে? উঁকি মেরে বুথের ভিতর চোখ বোলালাম। তৃণমূলের এজেন্ট সঞ্জয়কুমার নন্দী আর বিজেপি-র রাজকুমার বেরা দু’জনেই জানালেন, খুব ভাল ভোট হচ্ছে। বুথের একমাত্র রাজ্য পুলিশের কর্মীটিও সুর মেলালেন, ‘‘ভোটের হার খুব ভাল। দিনের শেষে মনে হচ্ছে ৯০%- এর কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।’’

কী উপায়ে? তৃণমূলেরই কারও কারও দাবি, ভোটকর্মী আর জওয়ানদের খাইয়েদাইয়ে, উপহার দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করা হয়েছে। তাই ভূতে এসে বোতাম টিপলেও তাঁরা কিছু দেখতে পাচ্ছেন না।

ফেরার পথে দেখা হল তুলসীর মালা গলায় এক প্রৌঢ়ের সঙ্গে। ওই বুথ থেকেই ভোট দিয়ে বেরিয়েছেন। ভোট কেমন চলছে? সাইকেলে উঠতে উঠতে প্রৌঢ়ের জবাব, “যাঁদের ভোট পাওয়ার তাঁরা ঠিকই পাচ্ছেন।”

অর্থাৎ তেনারা আছেন। আর তেনাদের কেরামতিতেই সুনসান বুথে দিনের শেষে ভোটের হার ৮৮%।

assembly election 2016
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy