ভোট-ভোজ। প্রচারে টালিগঞ্জের এক আবাসনে শোভন চট্টোপাধ্যায়।
দিদি ভাইকে ভুললে ভুলবে। ভাই তবু ভুলবে না।
রবিবার সেটাই প্রমাণ করলেন ফিরহাদ হাকিম ওরফে ববি। ঠিক এক রবিবার আগে নারদ-কাণ্ডে দাগি ভাইদের আগে জানলে বর্জন করার মতো সাঙ্ঘাতিক কথা বলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দক্ষিণ কলকাতায় ভোটের আগে শেষ রবিবারটা সেই দিদিকেই কার্যত উৎসর্গ করলেন ভাই ববি। ‘দিদি চেতলায় আসছেন, তার আয়োজনে ব্যস্ত থাকব’— শনি-রাতেই এসএমএসে জানিয়েছিলেন ভাই। এর পরে সারা দিন সংবাদমাধ্যমকে কার্যত এড়িয়ে চললেন তিনি। তাঁর চেতলার বাড়িতে খোঁজ করতে গিয়ে মালুম হল, সকাল ন’টা নাগাদ বেরিয়ে ঘণ্টা দুয়েক বাদে দশ মিনিটের জন্য ফিরেছিলেন। এর পরে ববি ফের অদৃশ্য। বিকেলে দিদির পদযাত্রা কালীঘাট ব্রিজের উপরে উঠতেই দেখা গেল, তাঁর জন্য অপেক্ষমান সহাস্য ভাই। তাঁর নিজের খাসতালুক চেতলা এখন মমতার ভবানীপুর কেন্দ্রের অন্তর্গত। ববি লড়ছেন কলকাতা বন্দর কেন্দ্রে। তাতে কী? চেতলায় মমতার পাশেপাশেই হাঁটলেন ববি।
আগামী শনিবার মমতার তৃণমূল পরিবারে যে ভ্রাতৃকুলের ভোট-ভাগ্য নির্ধারণ হবে, তাঁদের মধ্যে সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য মমতার ‘সুব্রতদা’। বিকেলে পার্ক সার্কাস ডন বস্কো-র কাছে নিজের কেন্দ্রের পরিচর্যাতেই যাঁকে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল। সন্ধ্যায় গোলপার্কের কাছে সুব্রত মিটিং করলেন পুরনো বন্ধু, বাঁকুড়ায় দলের সাংসদ মুনমুন সেনকে নিয়ে। সুব্রতর প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের কৃষ্ণা দেবনাথ তখন ব্রাইট স্ট্রিটে জোটসঙ্গী মহম্মদ সেলিমকে নিয়ে সভা করছেন।
নারদের হুল ফোটা ‘ভাই’দের অন্যতম শোভন চট্টোপাধ্যায়ও বেহালা (পূর্ব) কেন্দ্রে নিজের গড় সামলাতে ব্যস্ত। এই দুপুরে টালিগঞ্জ করুণাময়ীর কাছে এক আবাসনের কমিউনিটি হলে তাঁর দেখা মিলল। সেখানে আবার খোদ দিদির সহোদর, স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে বাবুনও তাঁর পাশে। কলকাতার উন্নয়নের প্রতীক-টতীক বলে গদগদ সম্ভাষণের শেষে মেয়র সাহেবের জন্য মজুত এক মস্ত নীল-সাদা কেক। ডগোমগো হেসে সকলের হাততালির মধ্যে শোভন সেই কেকে ছুরি বসালেন।
রবিবারের কলকাতায় আবাসনে আবাসনে প্রচার এ দিন অনেক প্রার্থীরই কর্মসূচি জুড়ে ছিল। তবে শোভন যেন ঈষৎ সাবধানী। একে প্রার্থী, তায় মেয়র। ঝকঝকে আবাসনে ঢুকতেই নারায়ণচন্দ্র দাস, সুরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, জয়ন্ত-গোপা মিত্রদের প্রশ্ন, মেয়র তো এখানে পা রাখলেন, কলকাতা পুরসভার জল কবে পৌঁছবে? ভোট প্রচারের মোক্ষম মুহূর্তে সে সব আর্জি প্রার্থী না পারছেন ফেলতে, না পারছেন গিলতে। শেষে নিজের সঙ্গে খাঁচায় বন্দি বেড়ালের তুলনা টানলেন। বললেন, ‘‘বন্দি বেড়ালকে প্লিজ খোঁচাবেন না! আমি এখন নির্বাচনী-বিধির বেড়াজালে বন্দি। সাংবাদিকেরা শুনলে কেলেঙ্কারি হবে।’’ মানে, মেয়রের পদ ব্যবহার করে কল্পতরু হলে প্রার্থীপদ কেঁচে যেতে পারে। তবে তিনি তো আবার পুরসভার ‘জল-শোভন’! জল-সমস্যা সমাধানে নিজের আন্তরিকতাটুকু বোঝাতে কসুর করলেন না। আবাসনের ভোটারদের সমস্যার সমাধানের প্রক্রিয়া যে জারি আছে, নানা ভাবে বুঝিয়ে তিনি গাত্রোত্থান করলেন।
ভবানীপুরে খাস্তা কচুরির জলযোগে দীপা দাশমুন্সি। রবিবার ছবিগুলি তুলেছেন সুদীপ্ত ভৌমিক।
যাদবপুরের জোটপ্রার্থী সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী তখন রামগড়ের এক আবাসনে চা-চক্রে মেতেছেন। সরাসরি প্রচার এড়িয়ে গেলেন। তবে কোনও চাপে মাথা না নুইয়ে নিজের মতটুকু ইভিএম-বন্দি করার কথাই জনে জনে বলে গেলেন তিনি। খিদিরপুরে পাঁচুবাবুর দোকানের পাশের মধ্যবিত্ত কলকাতার কাছে দীপা দাশমুন্সির উপস্থিতি আবার অন্য বার্তা বয়ে আনল। রাজনীতিতে পোড়খাওয়া হয়ে উঠলেও প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির স্ত্রী পরিচয়টুকু পাড়ায় এখনও দীপার পরিচয়পত্র! নমস্কার সেরে দীপা একটু সরতেই নিজেকে তৃণমূলকর্মী পরিচয় দিয়ে এক প্রৌঢ় বললেন, ‘‘এই ৭৭ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের অনেকেরই মনে নানা অভিমান। কখন কী হয়...!’’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্র ভবানীপুরের অন্তর্গত এ তল্লাটে সমস্ত তৃণমূল-বিরোধী ও বিজেপি-বিরোধী ভোট জোটের ভাঁড়ারে ভরার বার্তা দিয়ে মাইকের ডাকই খিদিরপুরে এ দিন ‘রাইজিং বেল’ হয়ে উঠেছিল। তবে খিদিরপুর-বাজার থেকে পদযাত্রা শুরুর ঢের আগে দীপার দিন শুরু হয়। সদর স্ট্রিটে জৈন ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনাসভা, গুরুদ্বারের পাশের চা-ঠেকে সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার থেকে জনসভা, দরজায়-দরজায় প্রচার, রবিবারে কোনও ফাঁক রাখলেন না তিনি।
তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কার্টুন-কাণ্ডখ্যাত অম্বিকেশ মহাপাত্রের মেজাজ খারাপ। বেহালায় মেয়রের সঙ্গে জোট-সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হয়ে লড়ছেন তিনি। স্থানীয় বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা তাঁর পাশে। তবু বেশ কিছু এলাকায় সন্ধ্যার পরে প্রচারে যেতে নিষেধ করছে পুলিশ। জোকার ১৪৩ নম্বর ওয়ার্ডে বেশ কয়েকটি মার্কামারা ‘ভূতেদের বুথ’ চিহ্নিত করে রবিবার সকালটা সেখানেই পড়ে থাকলেন তিনি। বেহালা (পশ্চিম) কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী কৌস্তুভ চট্টোপাধ্যায় তখন লাল পাঞ্জাবীতে সেজে সাইকেল চালাচ্ছেন। সরশুনায় ১২৭ নম্বর ওয়ার্ডে জমল এই ‘সাইকেল-র্যালি’। শাসক দলের হেভিওয়েট পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কাত করতে মরীয়া কৌস্তুভকে অনেকে হাত নাড়লেন। বললেন, ‘এ তো বেশ স্বাস্থ্যকর প্রচার!’
সন্ধ্যায় বেহালার জোট-সমর্থিত প্রার্থীদের জন্য হাঁটলেন বিমান বসু। তৃণমূলের বিদায়ী মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তখন ঠাকুরপুকুরে খান মহম্মদ রোড থেকে টলিউডের নুসরতকে পাশে নিয়ে প্রচারে বেরিয়েছেন। সোনামুখী বাঁশপোতা বাজারে পরের রোড-শোয়ে তাঁর সঙ্গী সন্ধ্যা রায়। পার্থ হেসে বললেন, ‘‘কোথায় কোন সেলিব্রিটি চলবে, তা-ও তো জানতে হয়!’’ নিংড়ে নেওয়া গ্রীষ্মের অস্বস্তিতে শহরে ভোটরঙ্গের এই ছোঁয়াটুকুই যা বিনোদন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy