সেই রাতের সাক্ষী হয়ে ভাঙা মোটরবাইকটা উঠোনে পড়ে আছে। একটু দূরে এখনও স্বচ্ছন্দে খোপের ভিতর-বাইরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে পোষা তিনটে পায়রা।
রাজ্যে দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ শুরুর মাত্র ১৪ ঘণ্টা আগে সবংয়ের মিঠাপুকুরে জয়দেব জানার বাড়ি। পাশের করণপাড়ায় শুক্রবার রাতে সংঘর্ষ এবং পিটুনির জেরে এ বারের ‘নির্বাচনের প্রথম শহিদ’ হয়েছেন তৃণমূলের বুথ সভাপতি জয়দেব। আর তাঁর শোকসন্তপ্ত উঠোনে রবিবার শেষ বিকেলে শান্তির দূতের উপস্থিতি পরিহাসের মতো লাগছে!
রাত পোহালে ভোট। বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর ও বর্ধমান জেলার যে ৩১টি বিধানসভা কেন্দ্র এই দফায় ভোটে যাচ্ছে, তার মধ্যে সবং আর নারায়ণগড়েই সারা রাজ্যের নজর। তার উপরে ভোট-পর্বের মাঝে সবংয়ে ঘটে যাওয়া খুন বঙ্গ রাজনীতিতে নতুন তাপ এনে দিয়েছে। তার পরেও গোটা তল্লাটে কোথায় কেন্দ্রীয় বাহিনী, কোথায়ই বা পুলিশ? বাম ও কংগ্রেসের সমর্থকেরা ভয় পাচ্ছেন, এলাকা অরক্ষিত রেখে শাসক দলের ভোট লুঠের চক্রান্তে মদত দেওয়া হচ্ছে। আবার তৃণমূলের কর্মীরাও খুনের ঘটনার তদন্ত নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে পাল্টা সরব হচ্ছেন!
হতে পারে সবং একটা খণ্ডচিত্র মাত্র। কিন্তু টুকরো টুকরো জুড়েই যদি বড় ছবিটা তৈরি হয়, তা হলে দ্বিতীয় দফার ভোটের আগে ফের আশঙ্কার কারণ আছে। এমনিতেই প্রথম দফার ভোটে ভূতেদের অশরীরী ভূমিকা ভোট-শতাংশের হিসাবে কারসাজি করে গিয়েছে! এর মধ্যে যেখানে জয়দেবের খুনের ঘটনা, তার থেকে আধ কিলোমিটার গেলে ময়না হয়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সীমানা। গোলমাল পাকাতে চাইলে বাইরে থেকে সীমানাবর্তী এলাকা দিয়ে ঢুকে আবার বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। একটা বড় ঘটনার পরে স্পর্শকাতর এলাকায় ভোটের আগের বিকালে নিরাপত্তার এই হাল হলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
জয়দেবের বাড়ির কাছে দুবরাজপুর পূর্ব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে অবশ্য এ দিন বিকেলেই এসে পৌঁছেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। কিন্তু তাদের হালও তখন সাগরে ডিঙি নৌকোর মতো! যাঁর নেতৃত্বে রয়েছে ওই বুথের বাহিনীর ইউনিট, তিনি বলছিলেন, ‘‘সবংয়ে এসে শুনেছিলাম এ দিকে একটা খুন হয়েছে। সেটা এখানে এত কাছেই, কোনও ধারণা ছিল না!’’ নিরাপত্তার অভাবে শাসক দলের বাহিনী কোথায় কী ভাবে গ্রামে ঢুকে শাসাচ্ছে, তার স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার জন্য পুলিশ পর্যবেক্ষক সুনীল দত্তকে বারবার যোগাযোগ করেছেন বিরোধী নেতারা। পর্যবেক্ষক ‘দেখছি’র বাইরে কিছু বলতে পারেননি।
খুনের পিছনে মানস ভুঁইয়াই— দুই ছেলেকে পাশে নিয়ে নালিশ নিহত জয়দেব জানার স্ত্রী মানসীর।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক এবং নারায়ণগড়ের প্রার্থী সূর্যকান্ত মিশ্র এই কারণেই বলছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঠিকমতো কাজে লাগানো হচ্ছে না। এই ভোটটা শুধু কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভরসায় হবে না। মানুষকেই আহ্বান জানাচ্ছি, বেরিয়ে এসে নিজের ভোট নিজে দিন এবং ভোট লুঠের চেষ্টা হলে আসুন আমরা সবাই মিলে প্রতিরোধ করি।’’ সবংয়ের কংগ্রেস প্রার্থী মানস ভুঁইয়ারও একই সুর, ‘‘কয়েক মাস ধরে বারবার বলে চলেছি, কমিশনকে অজস্র বার জানিয়েছি। তবু কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন ঠিকমতো হল না!’’ তৃণমূল অবশ্য মানসবাবুকেই গ্রেফতারের দাবিতে এখনও সরব। দুই কিশোর পুত্রকে পাশে নিয়ে নিহত জয়দেবের স্ত্রী মানসী জানা বলছিলেন, ‘‘মানসবাবুই লোকজন দিয়ে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে খুন করিয়েছেন ওকে। আগেও এলাকায় এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশ যাদের ধরেছে, তারা ছাড়া আরও অনেকে খুনে জড়িত।’’ নিহত জয়দেবের দোসর জয়দেব মেটিয়ার দায়ের-করা এফআইআরে (যার প্রতিলিপি আনন্দবাজারের হেফাজতে আছে) আরও স্পষ্ট অভিযোগ করা হয়েছে, শুক্রবার রাতে ফেরার সময়ে জয়দেব সদলবল প্রচাররত মানসবাবুর মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলেন। প্রথমে কংগ্রেস নেতা বিকাশ ভুঁইয়া ও অমল পণ্ডা জয়দেবের চুলের মুঠি চেপে ধরেন। পরে মানসবাবু নির্দেশ দেন, ওকে মেরে নদীর পাঁকে পুঁতে দে!
এই অভিযোগকে মানসবাবু অবশ্য স্রেফ কল্প-কাহিনি বলেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। প্রথমত, সে দিন তাঁর প্রচার ছিল পিংলায়। দ্বিতীয়ত, এ দিন এলাকায় গিয়েও মালুম হয়েছে, রাত সাড়ে ১০টায় সবং থেকে অন্তত ২৫ কিলোমিটার উজিয়ে এই প্রত্যন্ত গ্রামে কোনও প্রার্থীর প্রচার করতে আসা বেশ রোমাঞ্চকর বৈকি! তৃণমূলের উপস্থিতি প্রবল, এমন এলাকায় তৃণমূলেরই এক দাপুটে নেতা পিটুনির শিকার হওয়ার পিছনে অন্য রহস্য থাকাই স্বাভাবিক। বাম ও কংগ্রেসের অভিযোগ, গ্রামে ঢুকে তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার জন্য শাসানি এবং মহিলাদের নিয়ে টানাটানি করতে গিয়েই বিপত্তি। ঘটনাস্থলে এ দিন তৃণমূল কর্মীরা যে ভাবে সংবাদমাধ্যমকে দাবড়ানি দিয়েছেন, তাতে রহস্যে আরও ইন্ধন যোগ হচ্ছে!
তথ্যের খাতিরে, খুনের ঘটনায় শনিবার ৮ জনের পরে এ দিন আরও তিন জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যদিও অভিযুক্তদের তালিকায় তিন জনের নামই নেই। ধৃতদের মধ্যে ৯ জনকে জেল হেফাজত ও দু’জনকে আপাতত পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তৃণমূলের দাবি প্রসঙ্গে খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক গুপ্ত বলেছেন, ‘‘অভিযুক্তদের তালিকায় মানসবাবুর নাম রয়েছে। ওঁর বিরুদ্ধে কী প্রমাণ রয়েছে, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
প্রিয়জন হারানোর শোক, পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সত্ত্বেও মানসী অবশ্য জানিয়েছেন, আজ, সোমবার ভোটের লাইনে দাঁড়াবেন। হিংসাজর্জর এই গণতন্ত্রে ভোটই তো শুধু
শান্তির পায়রা!