Advertisement
E-Paper

আর নয়, এ বার রুখে দাঁড়ানোর পালা

সাত মাস আগে সল্টলেক পুরভোটে তাণ্ডব চালিয়েছিল শাসক দলের ভৈরববাহিনী। রুখে দাঁড়াতে গিয়ে মার খেয়েছিলেন কেউ কেউ। সোমবার বিধানসভার ভোট সেই সল্টলেকে। এ বারও কি একই ছবি? ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে বিধাননগরের বাসিন্দারা বলছেন, আর নয়...নতুন করে মনে জোর পাচ্ছি। আমরা তবে একা নই। প্রায় সাত মাস হতে চলল। ঘটনাটা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। বা বলা যায়, উঠতাম এত দিন। শুক্রবারের আনন্দবাজার দেখার পরে উদ্দীপ্ত হচ্ছি, বুকে বল পাচ্ছি। যখন দেখছি, গুন্ডাদের বাঁশের বাড়িতে দু’হাত ভেঙে যাওয়ার পরেও মাথা নোয়াচ্ছেন না এক শিক্ষক!

প্রীতিকুমার সেন

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১৪

নতুন করে মনে জোর পাচ্ছি। আমরা তবে একা নই।

প্রায় সাত মাস হতে চলল। ঘটনাটা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। বা বলা যায়, উঠতাম এত দিন। শুক্রবারের আনন্দবাজার দেখার পরে উদ্দীপ্ত হচ্ছি, বুকে বল পাচ্ছি। যখন দেখছি, গুন্ডাদের বাঁশের বাড়িতে দু’হাত ভেঙে যাওয়ার পরেও মাথা নোয়াচ্ছেন না এক শিক্ষক!

সাত মাস আগে নিজের পাড়ায় ঠিক ওই ভাবেই তো আক্রান্ত হয়েছিলাম আমি। বিধানসভা পুর-নির্বাচনে। দু’দিন বাদেই আসছে বিধানসভা ভোট। জানি না, এ বার কী দৃশ্য দেখব! শাসক দলের বিরোধিতা করলেই দেখেছি গায়ে রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়। চিরকাল এমনটাই হয়ে আসছে। আমি কিন্তু হলফ করে বলতে পারি— কোনও রাজনৈতিক বিচারে নয়, যে কেউই অন্যায় ভাবে আক্রান্ত হলে প্রতিবাদ করব। তৃণমূলের কোনও কর্মী আক্রান্ত হলেও একই ভাবে প্রতিবাদ করব। প্রতিবাদ করব ভোট গ্রহণের সময় চোখের সামনে যে কোনও রকম অনৈতিক আচরণ দেখলেই।

এ কথা সত্যি, দলগত আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস সকলের থাকে না। সে ক্ষেত্রে বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার জন্য দু’এক জন মানুষই প্রথমে এগিয়ে আসেন। তার পরে সকলে তাঁদের সঙ্গে এগিয়ে যান। সাত মাস আগের সেই দিনটায় আমি কিন্তু আগে থেকে তেমন কিছুই ভেবে রাখিনি। ঘটনাচক্রে প্রতিবাদের অঙ্গ হয়ে যাই। তার পুরস্কারে এই বৃদ্ধ বয়সে নিজের বাড়ির সামনে
রাস্তায় পড়ে আমাকে, আমার ছেলেকে মার খেতে হবে, সেটা জানা ছিল না। পরের দিনের আনন্দবাজারে নিজের সেই ছবি (ডান দিকে) দেখতে হবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি কখনও। কোনও দিন ভুলতে পারব না দিনটা।

৩রা অক্টোবর, ২০১৫। সল্টলেকে পুরসভার ভোট। এবি ব্লকের যথেষ্ট পুরনো বাসিন্দা আমি। অনেক ভোট দেখেছি। ভোটে গোলমালও দেখেছি। কিন্তু এই ভাবে বহিরাগত ছেলেদের এনে এলাকাটা একেবারে মুড়ে দিয়ে ভোট করানো দেখিনি। রাজনৈতিক দলগুলো যদি বহিরাগত দিয়েই ভোট করাবে বলে ঠিক করে, তবে সাধারণ
মানুষকে আগে থেকে বলে দিক। তাতে সময় ও অর্থ ব্যয় হয় না। আতঙ্কও থাকে না। কিন্তু ভোট দিতে যদি বুথে যাই, তা হলে নিজের ভোট নিজেই দেব। চোখের সামনে ছাপ্পা দেখলে, দাদাগিরি দেখলে প্রতিবাদ করব। ঠিক যেমন করেছিলাম সে দিন।

আমাদের বাড়ির সামনেই একটা পার্ক। পার্কটার ও পারে বুথ। বড়জোর তিন-চার মিনিটের হাঁটা পথ। সে দিন সকালে প্রথমে ভোট দিতে যান আমার স্ত্রী। তৃপ্তি সেন। অন্য বারের তুলনায় পরিবেশটা যে অন্য রকম, সেটা ওঁর মুখেই শুনলাম। বুথের ভিতরে প্রচুর অচেনা লোক। বাড়ির সামনে বাইক বাহিনীর দাপাদাপিও ভোর থেকে নিজেই দেখেছি। আমার স্ত্রী ফিরে এসে বললেন, বাইরে থেকে আসা ছেলেরা ওঁকে রীতিমতো গালিগালাজ করে কথা বলেছে। এ অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। একটু পরে নিজে গিয়ে দেখি, ভোটের নামে প্রহসন চলছে। বুথটা কার্যত বহিরাগতদের দখলে চলে গিয়েছে। লাইনে আমার সামনে দাঁড়িয়েছিল একটি কমবয়সি ছেলে। সে কিছু বলতে যেতেই গুন্ডারা ওকে ধরে মারতে শুরু করল। চোখের সামনে ও রকম দেখে আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে গলা চড়াতেই ওরা আমাকে ঘিরে ধরল। মাটিতে ফেলে লাথি, ঘুষি কিছুই বাকি রইল না। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে বেধড়ক মার খেল আমার ছেলে সুমনও।

আমার সেই প্রতিবাদের কথা তুলে ধরেছিল সংবাদমাধ্যম। তার পরে অনেকে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। স্থানীয় তৃণমূলের কিছু কর্মী থেকে শুরু করে টেলিফোনে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ও। তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে কেউ অবশ্য বাড়িতে আসেননি। অন্য দলের নেতা-কর্মীরা কিন্তু দেখা করে সমবেদনা জানিয়ে গিয়েছিলেন। আমার এবং আমার ছেলের চিকিৎসায় প্রায় আট হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। কে পূরণ করবে সেই ক্ষতি? বিভিন্ন দুর্ঘটনায় কেউ আহত হলে বা মারা গেলে প্রশাসন যদি ক্ষতিপূরণ দিতে পারে, তবে ভোটে হিংসার শিকার হলে নির্বাচন কমিশন কেন আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেয় না? এটা আমার বহু দিনের প্রশ্ন।

আশা করি বিধানসভা ভোটে হিংসার পুনরাবৃত্তি হবে না। সল্টলেকে শুনেছি রাজনৈতিক দলগুলির একাংশ সেই দাবি করেছে প্রচারে এসে। পুলিশ প্রশাসনও আশ্বস্ত করেছে। শান্ত নিরিবিলি সল্টলেকে শিক্ষিত
মানুষের বসবাস। এখানে আগে যে ভোটে গোলমাল হয়নি, তেমন তো নয়। কিন্তু ভোটের পরে সামাজিক ভাবে কখনও কোনও বিভেদ দেখা যায়নি। কেন জানি না, এখন রাজনৈতিক রঙের বিচারে মানুষকে ভাগ করা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দলগুলো সেটাকে সম্মান করতে শিখুক।

আমি এ বারও ভোট দিতে যাব। মনে জোর সঞ্চয় করেই যাব। চাইব, ভোট শান্তিপূর্ণ হোক। কিন্তু অন্যায় দেখলে মানবো না। কল্যাণীর ওই প্রহৃত শিক্ষক দম্পতি যদি পারেন,আমরা কেন পারব না? ঠিক যে কারণে বয়সে বড় হয়েও কামদুনির মৌসুমী-টুম্পাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি, সেই একই কারণে আমার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছেন উনি! কারণ ওঁরা সকলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলেছেন! সল্টলেকেও যদি বহিরাগতরা ফের মুক্তাঞ্চল গড়ে, আমি তো বটেই, আমি বিশ্বাস করি, আমার মতো আরও কেউ না কেউ ঠিক গর্জে উঠবে।

Assembly Election 2016 MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy