Advertisement
১৯ মে ২০২৪

শিশুদেরও মার, ভাঙচুর, তাণ্ডব, ভোটের হিংসা দক্ষিণ কলকাতা জুড়ে

নির্বাচন একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছনোর আগেই জেলায় জেলায় শুরু হয়ে গিয়েছে ভোট পরবর্তী হিংসা। ব্যতিক্রম হল না কলকাতাও। শনিবার ভোট মিটতেই বিভিন্ন জায়গা থেকে পর পর আসছে হামলার খবর।

ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়েছে এই ছবি।

ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়েছে এই ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মে ২০১৬ ১৯:২০
Share: Save:

নির্বাচন একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছনোর আগেই জেলায় জেলায় শুরু হয়ে গিয়েছে ভোট পরবর্তী হিংসা। ব্যতিক্রম হল না কলকাতাও। শনিবার ভোট মিটতেই বিভিন্ন জায়গা থেকে পর পর আসছে হামলার খবর।

শনিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ বালিগঞ্জের বেলতলা রোডে পেয়ারাবাগানের বস্তি। আচমকাই পরের পর বাড়িতে শুরু হল দুষ্কৃতী হামলা। এর মধ্যেই তপন পাত্র নামে এক জনের বাড়িতে চড়াও হয় কিছু দুষ্কৃতী। তপনবাবুর ভ্রাতৃবধূ স্মিতা পাত্র বালিগঞ্জ কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী কৃষ্ণা দেবনাথের ২৫২ নম্বর বুথের পোলিং এজেন্ট ছিলেন। অভিযোগ, তপন পাত্রকে ঘিরে ঘুষি মারতে থাকে ওই ছেলেরা। তখনই তাঁর মেয়ে, সাড়ে ৬ বছরের ঈশানী চিৎকার করে উঠলে কেউ এক জন তাকে পিছন থেকে তুলে ধরে ছুড়ে দেয় ঘরের কোণে। শনিবার রাতের ওই ঘটনায় হাত-পায়ে চোট পায় ওই শিশুটি।

শুধু ঈশানীই নয়, বেহালা হরিদেবপুরেও শনিবার রাতেই এলাকার অন্য কয়েক জন ‘কাকু’র হাতে মার খেতে হয়েছে দশ বছরের আর এক শিশু প্রীতিকেও। তার অপরাধ ছিল, তার বাবা এবং দাদু তৃণমূলের হুমকি উপেক্ষা করে ভোট দিয়ে এসেছেন শনিবার। অভিযোগ, রাতে তৃণমূল কর্মীরা বাড়িতে চড়াও হয়ে প্রীতির বাবা দীনেশ বরকে না পেয়ে হামলা চালায় প্রীতির উপর। লাঠির ঘায়ে ফাটিয়ে দেওয়া হয় তার কপাল।

শুধু শনিবার নয়, রবিবারও রাতভর পাটুলি থানা এলাকার গাঙ্গুলিবাগানের ফুলবাগান রোড সি ব্লক, জি ব্লকের এলাকা জু়ড়ে তাণ্ডবের খবর এসেছে। এই ঘটনায় রাজ্যের শাসক দলের প্রথম সারির এক তৃণমূল নেতার ঘনিষ্ঠ কাউন্সিলরের নাম জড়িয়ে গিয়েছে।

বাসিন্দারা জানান, রবিবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে এক একটি বাইকে তিন-চার জন করে বহিরাগত এলাকায় জড়ো হতে শুরু করে। তার পরেই রে রে করে ঢুকে পড়ে পাড়ায়। প্রায় সব বাড়িতে লাঠি, রড দিয়ে ঠুকতে ঠুকতে চিৎকার করতে শুরু করে। রাত ৯টা নাগাদ লাঠি, ইট, রড, বাঁশ নিয়ে একের পর এক সিপিএম কর্মীর বাড়িতে চড়াও হতে শুরু করে।

এই বাহিনীর মুখে প্রথমে পড়েন গাঙ্গুলিবাগানে জি ব্লকের সিপিএম কর্মী সুজন দত্ত। তাঁর বাড়িতে চড়াও হয়ে শুরু হয় মারধর। এর পর সেই বাহিনী চলে আসে সি ব্লকে ফুলবাগান রোডে মেলার মাঠে। পর পর ভাঙচুর হতে থাকে সিপিএম কর্মী কমল মজুমদার, সুজয় সাহা, বুদ্ধদেব ঘোষ এবং গৌরচন্দ্র সাহাদের বাড়ি। এর পর ওই বাহিনী চড়াও হয় পাটুলির কেন্দুয়া রোডে সুশান্ত নস্কর নামে আর এক সিপিএম কর্মীর বাড়িতেও। গাঙ্গুলিবাগানে সিপিএম পার্টি অফিসে এই খবর পৌঁছলে স্থানীয় নেতৃত্ব খবর দেন পাটুলি থানায়। কিন্তু অভিযোগ, ওই বাহিনী সিপিএম কর্মীদের মারধর এবং বাড়ি ভাঙচুর শেষ করে চলে যাওয়ার পরে পাটুলি থানার বাহিনী এলাকায় পৌঁছয়।

কী ভাবে চলে এই তাণ্ডব?

ফুলবাগান রোডে এই তাণ্ডবের সময়ে বাড়িতে একা ছিলেন সিপিএমের আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক বুদ্ধদেব ঘোষের মা, ৭৫ বছরের মায়ারানি ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘ছেলে বাড়ি ছিল না। হঠাৎই বাইরে মার মার করে চিৎকার। পর পর আধলা ইট পড়তে থাকে আমার ঘরে আর ঠাকুরঘরে। সঙ্গে আমার নাম করে অশ্লীল গালিগালাজ। পর পর ভাঙতে থাকল কাচ। কোনও রকমে চেয়ার, সিলিন্ডার দিয়ে দরজা আটকে রাখি আমি।’’ বুদ্ধদেববাবুর কথায়, ২০১১ সালে, এমনকী, ২০১৪ সালেও ভোটের পর আক্রান্ত হতে হয়েছিল তাঁর পরিবারকে। প্রতি বারই পুলিশকে জানানোর পরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

এই ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্ক রয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বছর পনেরোর অর্ণবের চোখেমুখে। অর্ণবের বাবা সিপিএম কর্মী কমল মজুমদারের হাতে চিড় ধরেছে। সে বলে, ‘‘আচমকাই চিৎকার করতে করতে বাড়ির সমস্ত পাইপলাইন ভেঙে দিল ওরা। তার পর ইট মেরে ভেঙে দিল বাড়ির সমস্ত কাচ। ভয়ে দাদুর ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এর মধ্যে বাবাকে সামনে পেয়ে মারতে থাকে ওরা। কিছু লোকজন এগিয়ে এলে ওরা পালিয়ে যায়।’’ ঘটনাস্থল ঘুরে দেখতে যান যাদবপুরের সিপিএম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী। আক্রান্ত প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। তিনি সরাসরি অভিযোগ করেন, ‘‘বাইরে থেকে দুষ্কৃতী এনে হামলা চালাচ্ছে তৃণমূল। কিছু দিন আগেই এই বিধানসভা কেন্দ্রের আর একটি এলাকার হামলায় ধরা পড়েছিল নাকতলার দুষ্কৃতী। পুলিশ সব জেনেও কিছু করছে না। এর পর অশান্তি হলে দায় নেবে কে?’’

এই ঘটনায় সিপিএম কর্মীরা সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে। তাঁদের অভিযোগ, এই তাণ্ডবের পিছনে সরাসরিই মদত রয়েছে তাঁর। যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করে বাপ্পাদিত্যবাবুর দাবি, ‘‘ঘটনার সময় আমি এলাকাতেই ছিলাম না। সিপিএমের খোকন ঘোষদস্তিদার, চন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার, বুদ্ধদেব ঘোষের প্ররোচনায় তাঁদের ছেলেরাই পাড়া জুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছে। থামাতে গিয়ে আহত হয়েছে আমাদের কয়েক জন কর্মী।’’ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ তুলে দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। সেই ফুটেজের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, ‘‘পুলিশকে ভাল করে সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখতে বলুন। বাইরের কোনও লোক ছিল না। পুলিশের একাংশ বিনা প্ররোচনায় আমাদের কার্যালয় থেকে ছেলেদের বার করে পিটিয়েছে, প্রচুর বাইক তুলে নিয়ে গিয়েছে।’’

ভোট পরবর্তী হিংসার খবর আসে ৯১ নম্বর ওয়ার্ডের বৈকুণ্ঠ ঘোষ রোডেও। স্থানীয় সিপিএম সূত্রের খবর, ওই এলাকায় বসেছিলেন চার-পাঁচ জন সিপিএম সমর্থক। আচমকাই তৃণমূল দুষ্কৃতীরা চ়়ড়াও হয়ে তাঁদের মারধর করে। শুধু তাই নয়, থানায় গিয়ে ওই সমর্থকদের নিজেদের বলে দাবি করে তৃণমূল আগে অভিযোগও দায়ের করে বলে অভিযোগ স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্বের। পাঁচ জনকে ভর্তি করা হয় বাঙুর হাসপাতালে। গুরুতর আহত হন সিপিএম কর্মী বাসু দাস, সুবীর অধিকারী, উত্তম ঘোষ নামে তিন কর্মী। রাতে বোসপুকুর রো়ডে বাজারের কাছে একটি পার্টি অফিসও ভাঙচুর হয়। সেখানে রাতে থাকেন এক কর্মী পার্থ পাল। তাকে লাল প্যান্ট পরে থাকার অভিযোগে উলঙ্গ করে মারধরের অভিযোগ করেছে সিপিএম। পরে সিপিএমের পক্ষ থেকে কালু মণ্ডল, রিন্টু মালিকের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। সিপিএম প্রার্থী শতরূপ ঘোষ বলেন, ‘‘ভোটের দিন পুলিশের কাজের প্রশংসা করেছিল কমিশন। মমতা ব্যানার্জি পুলিশকে হুমকি দেওয়ার পর মিইয়ে যাওয়া দুষ্কৃতীরা ফের উজ্জীবিত হয়ে পাড়ায় পাড়ায় তাণ্ডব চালাচ্ছে।’’ যদিও এই অভিযোগ মানতে চাননি তৃণমূল প্রার্থী জাভেদ খান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Post Poll violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE