ভোট দিয়ে বেরিয়ে অধরা মাওবাদী নেতার পরিবার। ছবি তুলেছেন সুদীপ্ত ভৌমিক।
বাড়ির বড় ছেলে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। তাঁর দলের রাজনৈতিক মতাদর্শ এমনই। সেই দল চায়, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে। তবে দেড় যুগ ধরে ফেরার, সেই মাওবাদী শীর্ষনেতার পরিবারের সবাই সোমবার সংসদীয় গণতন্ত্রেই পুরোপুরি আস্থা রাখলেন।
রঞ্জিত পাল ওরফে রাহুলের মা, বাবা, ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী সোমবার ভোট দিলেন প্রায় এক কিলোমিটার পথ চড়া রোদে হেঁটে। কোলে সতেরো দিন ও আড়াই বছরের দু’টো বাচ্চা নিয়ে।
ভোট দিয়ে বেরিয়ে রঞ্জিত পালের মা অলকা ও বাবা সত্যনারায়ণ জানাচ্ছেন, এ বার তাঁদের দীর্ঘদিন বাড়িছাড়া বড় ছেলেরও বোধ হয় ফিরে আসার সময় হয়েছে। ভাবার সময় হয়েছে, কীসে ভাল হবে।
আর রঞ্জিতের ছোট ভাই হরিপদর কথায়, ‘‘বিকাশ ধরা পড়ার খবর কাগজে পড়লাম। দাদা তো নিজেই বুঝতে পারছে, এ বার পুলিশের হাতে ধরা দিলে ওর-ই ভাল হবে। তবে সিদ্ধান্ত নেবে ও-ই।’’
শনিবার মাওবাদীদের রাজ্য মিলিটারি কমিশনের প্রধান বিকাশ কলকাতা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার পরে এই রাজ্যের বিপজ্জনক মাওবাদী নেতা বলতে বাকি রইলেন কেবল রঞ্জিত। কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও জানাচ্ছে, এ বার রঞ্জিত পাল ওরফে রাহুলই তাদের এক নম্বর লক্ষ্য।
রবিবারই সিআরপি-র ৩০৫ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কমান্ডান্ট, ঝাড়খণ্ডের মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা মুসাবনি থেকে বাঁকুড়ায় ভোটের ডিউটিতে আসা সঞ্জীব দ্বিবেদী বলছিলেন, ‘‘ঝাড়খণ্ডে মাওবাদীদের স্কোয়া়ডগুলোর মধ্যে বিপজ্জনক হল গুরাবান্ধা স্কোয়াড। তিন জনের নাম নিয়ে সব চেয়ে আলোচনা হয়। কানহুরা মুণ্ডা, সুপাই টুডু আর আপনাদের রঞ্জিত পাল। শুনেছি, ও তো এই বাঁকুড়া জেলারই ছেলে।’’
বারিকুলের খেজুরখেন্না গ্রাম থেকে দুবরাজপুর নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে ভোট দিতে পাল পরিবারের সদস্যেরা যখন বুথে ঢুকলেন, তখন বেলা ১০টা ২০। কোলে দু’-দু’টো দুধের বাচ্চা বলে লাইনে দাঁড়াতে হল না।
ভোট দিয়ে মিনিট সাত-আটেকের মধ্যেই বেরিয়ে এলেন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ মাওবাদী নেতার পরিবারের সদস্যেরা।
খেজুরখেন্নায় পাল পরিবারের ঘরের মাটির দেওয়ালে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি। বিঘে জমিতে চাষবাস ও টুকটাক হাঁস-মুরগি-ছাগলের ব্যবসা করে কোনওমতে দিন গুজরান সত্যনারায়ণের। ছোট ছেলে হরিপদ মধ্যমগ্রামের একটি গেঞ্জি-কারখানায় কাজ করে রোজ পান ১৭০ টাকা। যে দিন কাজ নেই, সে দিন টাকাও নেই। ছোট ছেলে হওয়ার ঠিক আগে হরিপদ গ্রামে এসেছেন। তার পর ভোট দেবেন বলে থেকে গিয়েছেন কিছু দিনের জন্য।
পাল পরিবারের ভোটকেন্দ্র, দুবরাজপুর গ্রামের ওই স্কুলের বুথের দায়িত্বে এ দিন ছিলেন সিআরপি অফিসার বসন্ত দত্তাত্রেয় শিণ্ডে। মহারাষ্ট্রে বাড়ি তাঁর, তবে কর্মসূত্রে বেশ কিছুকাল আছেন ঝাড়খণ্ডের মাওবাদী প্রভাবিত চাঁইবাসায়। উত্তেজনাবিহীন ভোট হচ্ছে, দিব্যি খোশমেজাজে ছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর ওই অফিসার। কিন্তু যখন শুনলেন মাওবাদী নেতা রঞ্জিত পালের বাড়ির লোকজন ভোট দিতে এসেছেন, তখন শিণ্ডের চোখমুখের ভাষা বদলে গেল। প্রশ্ন করলেন, ‘‘রঞ্জিত পাল আবার এই এলাকায় ঢোকেনি তো?’’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অলকা পাল জানাচ্ছেন, সেখানে আসবে কী, তাঁর বড় ছেলে দীর্ঘদিন ঘরছাড়া। তাঁর কথায়, ‘‘নাইনে ওঠার পরে ওর পড়াশোনার খরচ জোগানো আর সম্ভব হচ্ছিল না। কত লোকের দরজায় দরজায় ঘুরল, কেউ পড়াশোনার খরচ জোগাতে সাহায্য করল না। সেই দুঃখে, রাগেই সব ছেড়েছুড়ে চলে গেল।’’
রঞ্জিত পালের মা তাঁর বড় ছেলে সম্পর্কে বলছেন, ‘‘আসলে ছোট থেকেই ওর খুব বুদ্ধি। বুদ্ধি আছে বলেই তো এত দূর উঠতে পেরেছে। তা-ই না?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy