Advertisement
E-Paper

পায়ে আতঙ্কের বেড়ি, তবু ধর্ষণের চিহ্ন মেলেনি

সিঁড়ির নীচের ছোট্ট ঘরে ‘হাওয়াই চটি’র দাপাদাপি। ঘরের দাওয়ায় চটি খুলে ছুট্টে ঢুকে পড়েছে দস্যি পাড়াবেড়ানি। ‘‘আয়ুষ আর তুতুলের সিরিয়ালটা একটু দেখতে দেবে তো! কী সারা ক্ষণ অত খপর দেখ মা!’’

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১৩

সিঁড়ির নীচের ছোট্ট ঘরে ‘হাওয়াই চটি’র দাপাদাপি। ঘরের দাওয়ায় চটি খুলে ছুট্টে ঢুকে পড়েছে দস্যি পাড়াবেড়ানি। ‘‘আয়ুষ আর তুতুলের সিরিয়ালটা একটু দেখতে দেবে তো! কী সারা ক্ষণ অত খপর দেখ মা!’’

সাতপুরনো রঙিন টিভি জুড়ে তখন নীল-পাড় সাদা শাড়ি। ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বুঝে নেওয়া’র হুমকি। মেয়ের জ্বালায় মায়ের খবর দেখা শিকেয়।

চার বছর আগে ট্রেনের ভরা কামরায় এই মেয়ের মাথাতেই বন্দুক চেপে ধরেছিল রোগ-রোগা হাত-পায়ের লম্বা দু’টো লোক। আর এক জন নোংরামি করছিল, তাঁর সঙ্গে। চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে হিড়হিড় করে টেনে রেললাইনের ধারে নিয়ে যায় ওঁকে। মেয়েটা তখন কেলাস ফাইভ না সিক্স।

‘ধর্ষণ’ শব্দটার মানে কী, তখনও বুঝত না সেই দশ-এগারোর বালিকা। চার বছর বাদে সে এ বার মাধ্যমিক দিয়েছে। সারা ক্ষণ চোখেমুখে কথা! মা টিভি-তে ‘খপর’ দেখছে দেখলেই, মেয়ের শাসন— উ-উ-ফ! টিভি-তে খালি ধর্ষণ আর ভোটের ‘খপর’। তার থেকে সিরিয়াল ঢের ভাল!

মেয়ের চাপেই তাই পাল্টে যায় চ্যানেল। পাড়াগেঁয়ে সন্ধ্যায় টিভি-র কোলাহল থেকে সরে আসেন ত্রিশোর্ধ্ব দোহারা নারীও। থেমে থেমে বলেন, ‘‘এক বারটি ওঁর সঙ্গে দেখা হলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম। উনিও তো এক জন মহিলা? আর এক জন মহিলার বিষয়ে এমন কথা তিনি বলতে পারলেন? সব সাজানো ঘটনা?’’

জবাবটাও নিজেই খুঁজে বার করেন। ‘‘উনি তো আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন। এক বার যা বলেছেন, কী করেই বা ফেরাবেন? তবু বলার আগে এক বারটি খোঁজ নিয়ে দেখবেন না?’’ দু’বছর আগে লোকসভা ভোটের সময়ে কাটোয়ায় সভা করেছিলেন নেত্রী। তিনি অবশ্য সাহস করে যেতে পারেননি। পাছে কোনও বিপদ হয়, ‘নির্যাতিতার’ বারদুয়ারে পাহারা বসিয়েছে থানা।

চার বছর আগে নেত্রীর কথাগুলো এখনও বিঁধে রয়েছে।

চার বছর আগের সন্ধেটা সব পাল্টে দিয়েছে।

কাটোয়া থেকে কীর্ণাহার, কাঁদরা থেকে লাভপুর— সেলাইয়ের কাজে ট্রেনে-বাসে একা-একাই ঘুরে বেড়াতেন স্বামীহারা নারী। কখনও মেয়ে দু’টোও থাকত সঙ্গে। তিনি এখন পারতপক্ষে ঘরের বাইরে বেরোন না। বোলপুরের কাছে বাপের বাড়িই গিয়েছেন চার বছরে দু’বার। এ বার ভোটের বুথ যেখানে পড়েছে, সেই ইস্কুলে কিছু দিন হল মিড-ডে মিল রাঁধতে যাচ্ছেন। ব্যস, এইটুকুই! চার বছর আগের সেই সন্ধ্যাটা যেন দু’পায়ে অদৃশ্য বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে সচল স্বাবলম্বী নারীর। ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার টানার যুদ্ধই থমকে।

ন্যারো গেজ লাইনে অম্বলগ্রাম ও পাচুন্দি স্টেশনের মাঝে আমোদপুর-কাটোয়া লোকাল থামিয়ে ছিল যাত্রীদের মধ্যে মেশা লোকগুলো। লুঠপাটের পর মেয়েকে বন্দুক দেখিয়ে মাকে লাইনের ধারে টেনে নিয়ে যায় ওরা। ঘটনাটার পরে বাড়ির বাইরে পা রাখার কথা ভাবলেই বুক কাঁপত ‘নির্যাতিতা’র। এর মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা, ‘‘ওর স্বামী সিপিএম করে। কিচ্ছু হয়নি। সব সাজানো ঘটনা!’’ পেয়ারা গাছে ইলেকট্রিক তারের শক লেগে স্বামী তো মরে ভূত সেই কবে! সিপিএম তো দূরের কথা, জন্মে রাজনীতির ছায়া মাড়ায়নি কাটোয়া মহকুমার এই পাড়াগেঁয়ে পরিবার।

ভোটের হাওয়া থেকে এখনও দূরেই থাকেন নির্যাতিতা। ভোটের কথা ভাবলে মনটা তেতো হয়ে যায়। বলেন, ‘‘তখনও ভাবতাম সুবিচার পাব! বন্দিঘরে শয়তানটাকে চিনিয়ে দিয়ে রাগে জুতো মারতে গিয়েছিলাম! এখন ভাবলে নিজের প্রতিই করুণা হয়!’’ চার বছর আগের আশা মরে ভূত। ঘটনার পরেই যিনি বলেছিলেন ‘সব সাজানো’, তাঁর পুলিশ ধর্ষণ প্রমাণ করতে পারেনি আদালতে। কাটোয়া ধর্ষণ-কাণ্ডের শিকার ম্লান হাসেন, ‘‘পার্ক স্ট্রিট বা কামদুনিতে তা-ও ধর্ষণটা মেনে নিয়েছে আদালত! আমি কী পেলাম?’’ মুহূর্তের জন্য যেন চোয়াল শক্ত হয় গ্রাম্য নারীর! ‘‘ভরা ট্রেনে সবাই দেখেছে, যা দেখার! আমার অতটুকু মেয়েও কি জবানবন্দিতে মিছে কথা বলল?’’

ফরেন্সিক তথ্যপ্রমাণও কিছু পেশ করেছিল পুলিশ। অভিযোগকারিণীর পোশাকে বীর্যের চিহ্ন। কিন্তু সন্তুষ্ট হননি কাটোয়া ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক। ধর্ষণের সঙ্গে-সঙ্গে ট্রেনে লুঠপাটও হয়েছিল বলে জানায় পুলিশ। উদ্ধার করা টাকাকড়ির ফিরিস্তি কোর্টে জমাও পড়ে। কিন্তু সে প্রমাণ যথেষ্ট বলে মানেনি বিচারক। অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস হয়ে যায় গত নভেম্বরে।

দুই মেয়ের মায়ের এখন মনে হয়, ঢের হয়েছে। যা হওয়ার তো হল! এ বার মেয়েগুলোর দিকে তাকাতে হবে! বড়টি উচ্চ-মাধ্যমিক দিয়েছে! কাটোয়া বা কাঁদরার কলেজে যাবে এ বার! মাধ্যমিক দিয়ে ছোটটিরও কত স্বপ্ন! মা বলেন, ‘‘এখনই ওদের বিয়ের কথা ভাবছি না! তবে সম্বন্ধ এলে লুকোব না যে আমি ধর্ষণের শিকার! আমি তো দোষ করিনি কোনও।’’ জেল থেকে বেরোনো লোকগুলোর কথা ভাবলে বুকটা ছ্যাঁত করে তবু। যদি ফের আসে! হাইকোর্টে মামলা লড়ার কথা বলতে এসেছিল ‘সেভ ডেমোক্রেসি’! সিপিএমের লোকেরাও বলেন হাল না-ছাড়তে। কিন্তু ভাসুর ঠাকুর নিষেধ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘জলে থেকে কি কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যায়! কাছেই বীরভূমের লাভপুর। হিরাপুর গ্রামে ওদের ডেরা। চার বছর তো দেখলাম, আবার কী!’’

‘‘অভিযোগকারিণী হাল ছাড়লেও সরকার কেন ছাড়বে?’’— প্রশ্ন করেন মামলার সরকারি কৌঁসুলি কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়। নিজে তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি হয়েও মুখ্যমন্ত্রীর কথা মানতে পারেননি। পরে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলা হেরে ইস্তফা দিতে যান। তিনি এখনও মনে করেন, হাইকোর্টে কেসটা লড়া উচিত সরকারের। আইন দফতর কি নড়ে বসছে তবে? নির্যাতিতার পাশে দাঁড়াচ্ছে সরকার? বিদায়ী আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে কলকাতায় ফোনে ধরতে ভারী বিরক্ত তিনি। বলেন, ‘‘দেখছেন তো ভোটে ব্যস্ত! পদযাত্রায় আছি।’’

ভোটের আঁচ বর্ধমান-বীরভূম সীমানার এই গ্রামেও। ঘুঁটে লেপা দেওয়ালে পাল্লা দিয়ে ছড়া লিখেছে জোট আর তৃণমূল। বীরভূমে শাসক দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার অনুচরদের নানা গল্প ভাসে এ তল্লাটেও! এ বারও কি দেখা যাবে বাইক-বাহিনী? এ সব আলোচনা কানে ঢোকে না ঘা-খাওয়া নারীর। আনমনে বলেন, ‘‘ভোট তো দিতেই হবে! কিন্তু মেয়ে দু’টোকে নিয়ে ভয়ে-ভয়ে বাঁচার শেষ কবে...’’

শুনতে পেয়ে সিরিয়াল থেকে মুখ তোলে ছোট মেয়ে। মায়ের অপমানের সাক্ষী কিশোরী টরটরিয়ে বলে, ‘‘ভয় পেরিয়েই তো জয় করতে হয়!’’

দিনশেষের মরা আলোয় চোখাচোখি মা ও মেয়ের। নারী জন্মের গুমরে থাকা ভাষায়, ধিকি-ধিকি জ্বালার ঝিলিক।

Annya Vote Riju Basu assembly election 2016
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy