Advertisement
E-Paper

রাইফেল নামিয়ে অভ্যর্থনা মনে থাকবে

দশ ফুট বাই দশ ফুট। স্কুলের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই চোখে ধাঁধা লেগে গেল। এইটুকু ঘরেই কিনা দু’টি বুথ। মহিষাদল বিধানসভার গোপালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই ঘরটি প্লাইউড দিয়ে দু’ভাগ করা হয়েছে। ঘরের দু’টি বুথে ভোটাররা কী ভাবে ঢুকবেন আর বেরোবেনই বা কী ভাবে, কিছুই বুঝতে পারলাম না।

অনিমিখ পাত্র (পোলিং অফিসার)

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৬ ০০:৫৬

দশ ফুট বাই দশ ফুট।

স্কুলের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই চোখে ধাঁধা লেগে গেল। এইটুকু ঘরেই কিনা দু’টি বুথ। মহিষাদল বিধানসভার গোপালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই ঘরটি প্লাইউড দিয়ে দু’ভাগ করা হয়েছে। ঘরের দু’টি বুথে ভোটাররা কী ভাবে ঢুকবেন আর বেরোবেনই বা কী ভাবে, কিছুই বুঝতে পারলাম না।

আগের লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত ভোটে আমি প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব সামলেছি। এ বার পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পড়ায় অবাকই হই। ভোটের সময় স্কুলের চেহারাগুলোই পাল্টে যায়। চারিদিকে পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান- তখন চেনা স্কুলও অচেনা ঠেকে।

যাই হোক, ভোটের আগের দিন রাতে সব গুছিয়ে খেয়ে নিলাম। রাজস্থানের বিকানির থেকে এসেছেন একজন সিনিয়র অফিসার। তিনি ভোটকেন্দ্রে ঢোকার পর থেকেই বলছিলেন, ‘‘স্কুলের জীর্ণ ঘরের ভঙ্গুর জানালার ধারে ইভিএম রাখতে তাঁর ভরসা হচ্ছে না।’’ তাই তিনি ও আর এক জওয়ান ইভিএম বগলদাবা করে শুয়ে পড়লেন।

তারপর শোওয়ার তোড়জোড় শুরু। ছোট্ট ঘরের মেঝেতে একটা চাদর পেতে কোনওক্রমে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া আর কী! ঘিঞ্জি ঘরে ঠ্যাসাঠেসি করেই শুয়ে পড়লাম। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বাইরে বারান্দায় কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম।

বাইরে বেরিয়ে দেখি, এক অদ্ভুত জগত। তখন সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথাও কোনও শব্দ নেই। একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে। স্কুলের মাঠে টাঙানো শামিয়ানা ছুঁইয়ে তখনও টপটপ করে জল পড়ছে। পাশেই পানের বরোজ। বাল্বের হলুদ আলোয় যেন এক অন্য পৃথিবী। তখন এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, এত অসুবিধার মধ্যে এ যেন এক অন্য প্রাপ্তি। ভোটের জন্য না এলে হয়তো এটা দেখাই হত না। ভোররাতে ঘুমোতে গেলাম।

ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ ঘুম ভেঙেও গেল। তখনও ভোট শুরু হতে ঢের দেরি। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের সঙ্গে গল্প শুরু হল। আমাদের ভোটকেন্দ্রে ফরিদাবাদের বাসিন্দা এক জওয়ান নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। দশ বছরের মেয়েকে তিন মাস দেখেননি। কাজের এতই চাপ। ভোটকেন্দ্রের পাশেই এক ছোট্ট মেয়েকে দেখে তাঁরও নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। মেয়েটিকে কাছে ডেকে হিন্দিতে ওই জওয়ান বাড়ির কত গল্পই না করলেন। আমি আবার জওয়ানের কথার বাংলা তর্জমা করে দিলাম।

সকাল হতেই শুরু গণতন্ত্রের উৎসব। সারাদিন নির্বিঘ্নে ভোটপর্ব মিটেও গেল। তবে এই ছোট্ট ঘরে প্রথম পোলিং অফিসারের দায়িত্ব নিয়ে ভোটের কাজ করতে করতে এটাও মনে হল, ভোটের প্রশিক্ষণের সময় তো কত কিছু জেনেছি, শিখেছি। তার সবটা যে বাস্তবে করা যায় না, তা আরও একবার মালুম হল। কত মানুষ খালি পায়েও ভোট দিতে এলেন। তাঁদের চোখেমুখে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট।

এক মানসিক প্রতিবন্ধী অল্পবয়সী ছেলেও ভোট দিতে এসে কিছুতেই হাতে কালি লাগাতে চাইছিল না। বাবা-মা জাপ্টে ধরে তাঁকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। ধরেবেঁধে রীতিমতো যুদ্ধ করে তাঁর আঙুলে কালি লাগিয়ে দিলাম। মনে হল, বছরের বাকি দিনগুলো ওঁদের কেউ পাত্তা দেয় না, হয়তো ব্যঙ্গবিদ্রুপও করে সকলে। কিন্তু আজ তো ওঁরা শুধুই সাধারণ মানুষ নন, আজ ওঁরা ভোটার। তাই তাঁদের জন্য বরাদ্দ বাড়তি গুরুত্ব। বাকি দিনগুলো যদি এমন হত, ভালই হত আর কী।

ভোটপর্ব নির্বিঘ্নেই মিটে গেল। এ বার বাড়ি ফেলার পালা। বাড়ি ফেরার আনন্দের মাঝেও কোথাও যেন একটু খারাপও লাগল। ফরিদাবাদের সেই জওয়ানের সঙ্গে হাত মেলালাম, আর হয়তো কোনও দিন তাঁদের সঙ্গে দেখা হবে না। রাইফেল মাটিতে রেখে তাঁদের সেই উষ্ণ বিদায় অভ্যর্থনা চিরদিন মনে থেকে যাবে।

(লেখক হলদিয়া গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক)

assembly election 2016 candidate
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy