মহিষাদলে রঘুনাথ পণ্ডা ও নন্দকুমারে সিরাজ খান। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
যুদ্ধটা মেঘনাদের মতোই আড়ালে থেকে। তবে ভূমিকা বিভীষণের।
২০০৮ সালে বাম জমানায় মহিষাদলের তৃণমূল নেতা রঘুনাথ পণ্ডার বিরুদ্ধে খুনের মামলা করেছিল তৎকালীন শাসক দল। মামলা এখনও চলছে। কিন্তু এ বার ভোটে সেই রঘুনাথই মহিষাদলে বাম-কংগ্রেস জোট সমর্থিত নির্দল প্রার্থীর অন্যতম ভোট-কাণ্ডারী। নির্দল প্রার্থীর প্রতীক —নৌকা।
বৃহস্পতিবার দিনভর রবীন্দ্র পাঠাগারের উল্টো দিকে খুপরি ঘরে বসে ফোনেই ভোট-যাপন করলেন ১৯৯৮ সাল থেকে মহিষাদলে তৃণমূলের সংগঠনের অন্যতম কারিগর রঘুনাথ। নিজের সৈনিকদের কাছ থেকে লাগাতার খবর নিয়ে গেলেন, ‘‘সুব্রত মাইতি (জোট-প্রার্থী) জিতবেন তো?’’ আর ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে আসা খবর শুনে হিসেব কষে গেলেন কোথায় ‘লিড’, কতটা ‘লিড’। রঘুনাথ-ঘনিষ্ঠদের কথায়, ‘‘দাদার এটা ধর্মযুদ্ধ। কারও ওঁকে বিভীষণ মনে হলে, হবে।’’
তৃণমূলের প্রতীকে পঞ্চায়েত ভোটে জিতেছেন, পঞ্চায়েত প্রধান হয়েছেন, এমনকী, পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষেরও দায়িত্ব সামলেছেন কেশবপুর ভবতারণ বাণীমন্দিরের কর্মশিক্ষার প্রাক্তন শিক্ষক রঘুনাথবাবু। এমন এক নেতাই এ বার কার্যত কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূলের। দল থেকে বেরিয়ে ‘মহিষাদল বিধানসভা নাগরিক মঞ্চ’ গড়েছেন। খোলাখুলি তৃণমূল-বিরোধীকে সমর্থন করার ঘোষণা করেছেন। তাঁর সে আহ্বান শুনেই সিপিএম নেতা পেশায় চিকিৎসক সুব্রত মাইতি দলের প্রতীক ছেড়ে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
বাম শিবিরের বক্তব্য, ‘‘আমরা সরাসরি রঘুনাথবাবুর সমর্থন নিলে লোকের কাছে ভুল বার্তা যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই বহিরাগত নয়, স্থানীয় প্রার্থী— এই আবেগকে সামনে রেখেই গাঁটছড়া বাঁধা হয়েছে।’’ একে জোট, তায় বিক্ষুব্ধ তৃণমূল দোসর—এই পরিস্থিতিতে মহিষাদল প্রার্থী তালিকায় দেখা গিয়েছে সুব্রত মাইতি নামে আর এক নির্দল প্রার্থীর নাম। এলাকায় গুঞ্জন, জোট সমর্থিত সুব্রতবাবুকে আটকাতেই দ্বিতীয় সুব্রতর আবির্ভাব।
ভোটের আগে নারদ-কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছে তৃণমূল। কিন্তু মহিষাদলে যে দলের পুরনো লোকেরাই এমন কাঁটা হয়ে উঠবে, তা ভাবতে পারেননি শাসক দলের নেতারা! পাশের বিধানসভা নন্দকুমারই বা কম কীসে? সেখানে জোট সমর্থিত নির্দল প্রার্থী ব্যবসায়ী সিরাজ খান এক সময় শাসক দলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে এক মঞ্চে দেখাও গিয়েছে তাঁকে। এ বার তাঁকে অবশ্য ‘মীরজাফর’ বলছেন তৃণমূলের লোকেরা। সিরাজ তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্বীকার করেননি। এবং বলেছেন, ‘‘আমার লড়াই শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে। এলাকায় উন্নয়ন না করার ক্ষোভে।’’
সিরাজ না হয় ভোটে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু ভোটে না দাঁড়িয়ে, ভোটের দু’মাস আগে ‘নাগরিক মঞ্চ’ নামে তথাকথিত অরাজনৈতিক সংগঠন খুলে দলের বিরুদ্ধে গেলেন কেন রঘুনাথবাবু? কেন-ই হাত মেলালেন বিরোধী পক্ষের সঙ্গে?
প্রবীণ এই শিক্ষকের কথায়, ‘‘মহিষাদলের ভালর জন্য।’’ এলাকার ভাল কি তৃণমূলে থেকে করা যেত না? রঘুনাথবাবুর ব্যাখ্যা, তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী বিধায়ক সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার ২০১১ সালে মহিষাদল থেকে জিতে মন্ত্রীও হন। কিন্তু সচরাচর এলাকায় আসতেন না। মহিষাদলের লোকেরা বিধায়কের দেখা পেতেন না, বিধায়কের কাছ থেকে শংসাপত্র বা অন্য সাহায্য পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হতেন। ফলে, তিনি চেয়েছিলেন, এ বার অন্তত স্থানীয় কোনও নেতাকে দাঁড় করানো হোক। মহিষাদলের সমস্যার কথা বিধানসভায় উঠুক। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ফের সুদর্শনবাবুকে দাঁড় করাবে জেনেই বেঁকে বসেছেন তিনি। বলছেন, ‘‘সুব্রতবাবু এলাকার ভূমিপুত্র। হতেই পারেন তিনি বামপন্থী, কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।’’ কথা বলতে বলতে ফের মোবাইল বেজে উঠল। ফোন ধরে স্পিকার চালু করলেন। বললেন, ‘‘কী রে বাবা, কেমন ভোট হল?’’ ও-পারের জবাব, ‘‘দাদা, চিন্তা নেই। এ বুথে লি়ড পেয়ে গিয়েছি।’’
তৃণমূলের একাংশ অবশ্য বলছেন, দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে কোণঠাসা হয়েই দলবিরোধী কাজে নেমেছেন রঘুনাথ। সুযোগ বুঝলে ফের ‘পাল্টি খাবেন’।। প্রসঙ্গ পাড়তেই একমুখ হাসি নিয়ে রঘুনাথবাবু বললেন, ‘‘লোকে কত কিছু বলবে। আমি কোনও দুর্নীতি করেছি? সারদা-নারদায় জড়িয়েছি?’’ খোঁচাটা কি জেলা তৃণমূলের ‘একচ্ছত্র অধিপতি’র বিরুদ্ধে? নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক রঘুনাথ বলছেন, ‘‘শুধু উনি নন, স্টিং ভিডিও-য় এক জনের স্ত্রীকেও (কাকলি ঘোষদস্তিদার) তো দেখা গিয়েছে।’’
মহিষাদলে ‘রঘুনাথ-ফ্যাক্টর’ অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছেন তৃণমূল প্রার্থী সুদর্শন। বলছেন, ‘‘আপনার যা খুশি লিখতেই পারেন। তবে মহিষাদলের ভোট হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা উন্নয়নকে সামনে রেখে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy