নতুন এসপি সব্যসাচী রমণ মিশ্র।
ঘটনা ১: জেলায় বাম জাঠায় বেনজির হামলার পরেও অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার-সহ ছ’জন আজও অধরা। শুধু ওই ঘটনায় নয়, জেলায় পরোয়ানা জারি থাকা প্রায় তিনশো অভিযুক্তও এখনও অধরা।
ঘটনা ২: বিরোধীদের কাছ থেকে লাগাতার অভিযোগ পেলেও রামপুরহাটের আইসি, লাভপুরের ওসিদের বিরুদ্ধে তিনি কোনও পদক্ষেপ করেননি।
ঘটনা ৩: জেলায় অতি স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে নিয়মিত আকারে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা মিলছিল না।
যার নিটফল— শাসকদল তৃণমূলের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগে বীরভূমের পুলিশ সুপারের পদ খোয়ালেন সেই বহু চর্চিত মুকেশ কুমার। আর সেই সঙ্গে বীরভূমে বজায় রইল নানা বিতর্কে জড়িয়ে পুলিশ সুপারদের পরপর আসা-যাওয়ার ‘ট্র্যাডিশন’ও। স্বাভাবিক ভাবেই ভোটের দু’দিন আগে মুকেশের অপসারণে খুশির হাওয়া বিরোধী শিবিরে। উল্টো দিকে, দুম করে ‘চেনা’ এসপি-কে হারিয়ে চাপের মুখে শাসকদল।
ঘটনা হল, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জেলায় পুলিশ সুপার বদলি হওয়ার এই রেওয়াজ অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরে সমানে চলছে। যার জেরে গত চার বছরে সাত-সাত বার পুলিশ সুপার বদল দেখেছে এই জেলা। কখনও সেই বদল হয়েছে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তে। কখনও বা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে। মাত্র পাঁচ মাস দায়িত্বে থাকতে না থাকতেই জেলা পুলিশ সুপার সি সুধাকরকে বদলে অলোক রাজেরিয়াকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সুধাকরের আগে মুরলীধর শর্মাকে সরিয়ে ফেলা হয় মাত্র আট মাসেই। লোবা-কাণ্ডের জেরে আবার সরানো হয়েছিল হৃষিকেশ মিনাকে। তারও আগে জেলার দায়িত্বে থাকা নিশাদ পারভেজ এবং রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়দের কার্যকালের মেয়াদও ছিল এগারো মাস করে।
কেন সরতে হল মুকেশকে?
জেলায় দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন ঘটনার অভিজ্ঞতায় মুকেশের বিরুদ্ধে শাসকদলের নির্দেশ মতো কাজ করার অভিযোগ তুলতে শুরু করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘর্ষ-খুনের ঘটনায় জেলা পুলিশের দু’রকম আচরণের নানা নিদর্শন তৈরি হয় তাঁরই আমলে। বিরোধীদের ক্ষোভ, যখনই তাঁরা আক্রাম্ত হয়েছেন, ঘটনায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অধিকাংশকেই ধরা হয়নি। মহম্মদবাজারে সিপিএমের মিছিলে হামলাই হোক কিংবা ময়ূরেশ্বরে বাম জাঠায় হামলা (যেখানে প্রবীণ সিপিএম নেতা ধীরেন লেটকে মারধর করে কান ধরে ওঠবোস করানো হয়)— তৃণমূলের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কার্যত ‘নিষ্ক্রিয়’ই থেকেছেন মুকেশ। অথচ কোনও ঘটনায় বিরোধীরা অভিযুক্ত হলে এই জেলার পুলিশের মধ্যে অতি তৎপরতা দেখা যেত। এমনকী, একই ঘটনায় বাম কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে জামিনঅযোগ্য ধারা দিলেও তৃণমূলের ক্ষেত্রে জামিনযোগ্য লঘু ধারা প্রয়োগ করার দৃষ্টান্তও তৈরি করেছে এই জেলার পুলিশ। শুধু রাজনৈতিক ঘটনাই নয়, সিউড়িতে বিচারক নিগ্রহের মামলাতেও নিষ্ক্রিয়তা দেখা গিয়েছিল পুলিশের মধ্যে। মুকেশের নেতৃত্বে থাকা পুলিশ ওই ঘটনায় ঠিক কারা জড়িত, তা এত দিনেও হদিস করতে পারেনি।
২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫। ওই দিনে দায়িত্বে এসেছিলেন মুকেশ কুমার (ডান দিকে), বেরিয়ে যাচ্ছেন অলোক রাজোরিয়া (বাঁ দিকে)।— ফাইল চিত্র
মুকেশকে নিয়ে যে শুধু বিরোধীদেরই অভিযোগ এমনটা নয়। তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষোভ কম ছিল না পুলিশের নিচুতলাতেও। জেলা পুলিশের একাংশের বক্তব্য, কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের কাঁধে বন্দুক নিতেন না এসপি। তাঁর বিরুদ্ধে নিচুতলার পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও উঠছে। এ ব্যাপারে মুকেশের আমলে প্রায় ৬৭টি ক্ষেত্রে অধস্তন কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও উঠছে। এর ফলে পুলিশের অন্দরে অনেকেরই ক্ষোভ রয়েছে তাঁর উপরে। মুকেশের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, দুবরাজপুর-খয়রাশোল এলাকায় বেআইনি কয়লা কারবার বন্ধ করতেও তিনি ব্যর্থ। গোটা বিষয়টিতে কার্যত চোখ বন্ধ করেই ছিলেন।
এ দিকে, মুকেশের অপসারণকে তাঁদের নৈতিক জয় হিসেবেই দেখছেন বিরোধীরা। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা সিউড়ির প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম বলেন, ‘‘ওই পুলিশ কর্তা আদতে নির্লজ্জ দলদাসে পরিণত হয়েছিলেন। রাজ্য কমিশনে অভিযোগ করলেও তারা কিছু করেনি। শেষমেশ কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনে জানাই। ওকে সরানোই জেলায় অবাধ ভোটের সম্ভাবনা বাড়ল।’’ মুকেশ এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। একই রকম ভাবে প্রতিক্রিয়া দেননি অপসারিত লাভপুরের ওসি দেবাশিস ঘোষও। সাম্প্রতিক অতীতে বিরোধীরা বারবার তাঁর বিরুদ্ধে পক্ষপাতের নালিশ জানিয়েছে। অন্য দিকে, তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের প্রতিক্রিয়া, ‘‘নির্বাচন কমিশন যা ভাল বুঝেছে করেছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy