Advertisement
১১ জুন ২০২৪

ঘাড়ের উপরে খাঁড়ার ভয়, তবে কি বদলি

বন্ধ দরজার ও পারে এখন থরহরি কম্প। এমন সব প্রশ্নপত্র পাতে পড়ছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই ঢোক গিলছেন জেলার বাঘা বাঘা প্রশাসনিক ও পুলিশ কর্তারা। তাঁদের জবাব যে সব সময় প্রশ্নকর্তাদের সন্তুষ্ট করতে পারছে, তা-ও নয়। আর তাতেই চড়ছে আশঙ্কার পারদ— বদলির তালিকায় এ বার কি তবে আমার পালা?

নজরদারি দল এ বার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক অনিল কুমার ঝা ও জেলাশাসক পি ভি সেলিমকে স্বাগত জানাচ্ছে নির্বাচন কমিশনের ম্যাসকট। সোমবার। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

নজরদারি দল এ বার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক অনিল কুমার ঝা ও জেলাশাসক পি ভি সেলিমকে স্বাগত জানাচ্ছে নির্বাচন কমিশনের ম্যাসকট। সোমবার। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৬ ০৪:১০
Share: Save:

বন্ধ দরজার ও পারে এখন থরহরি কম্প। এমন সব প্রশ্নপত্র পাতে পড়ছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই ঢোক গিলছেন জেলার বাঘা বাঘা প্রশাসনিক ও পুলিশ কর্তারা। তাঁদের জবাব যে সব সময় প্রশ্নকর্তাদের সন্তুষ্ট করতে পারছে, তা-ও নয়। আর তাতেই চড়ছে আশঙ্কার পারদ— বদলির তালিকায় এ বার কি তবে আমার পালা?

যেমন, জলপাইগুড়ির এক বৈঠক। বিশেষ পর্যবেক্ষকরা সেখানে জানতে চান, কতগুলো পোলিং বুথ প্রশাসনের কর্তারা ঘুরে দেখেছেন? জবাব আসে, অধিকাংশ। তখন পর্যবেক্ষকদের পাল্টা প্রশ্ন, অধিকাংশ মানে কত? বাধ্য হয়েই প্রশাসনিক কর্তা জানান, ৮০%। এক পর্যবেক্ষক তখন উল্টে বলেন, বাকি ২০% বুথ ঘুরে দেখার জন্য কি নতুন অফিসারকে দায়িত্ব দিতে হবে!

যেমন, দক্ষিণবঙ্গের এক জেলাশাসকের অবস্থা। তাঁর কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান, বিশেষ পর্যবেক্ষকদের কত দিন পরে মূল পর্যবেক্ষক আসছেন? ওই জেলাশাসক, যাঁর বিরুদ্ধে বরাবরই বিরোধীরা শাসক-ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ এনে থাকেন, দৃশ্যত কিছুটা হতাশ। বললেন, ‘‘নিজে কত দিন আছি, সেটাই জানি না। ওঁরা কবে আসবেন, কী করে বলব!’’

বাদ যায়নি খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্র। রিটার্নিং অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বিশেষ পর্যবেক্ষক অনিলকুমার ঝা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ভুয়ো ভোটারদের নাম খুঁজে বার করে তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘‘তালিকায় সাজানো ভোটার কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।’’

স্বস্তি নেই পুলিশকর্তাদেরও। শিলিগুড়িতে প্রাক ভোট অভিযানে কিছু আগ্নেয়াস্ত্র, মাদক উদ্ধার হলেও বোমা মেলেনি। এক পর্যবেক্ষক বলেন, কোথাও বোমা নেই, এটা হতে পারে! শিলিগুড়ি কি স্বর্গের কাছাকাছি কোনও জায়গা নাকি!

প্রশাসনিক ও পুলিশকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই শাসক ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে অনেক ওসি, বিডিও-র বিরুদ্ধেও। সুষ্ঠু ও অবাধ ভোটের স্বার্থে এর মধ্যেই ৩৮ জনকে বদলি করেছে নির্বাচন কমিশন। সেই তালিকায় রয়েছেন অর্ণব ঘোষ, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভারতী ঘোষের মতো অফিসার, যাঁদের নামে বরাবর সরব বিরোধীরা।

কমিশনের এই কঠোর মনোভাব এর মধ্যেই প্রশাসনের সব স্তরে কাঁপুনি ধরিয়েছে। যা শুনে বিরোধীরা বলছেন, সে তো ধরাবেই। কারণ এখনও তো অনেক অফিসার আছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে শাসক-ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের এক জেলাশাসকের নাম এই সূত্রে উল্লেখ করেছেন তাঁরা। তিনি এক সময় উত্তরবঙ্গেও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। বিরোধীদের দাবি, ওই জেলাশাসক এতটাই তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ যে, তাদের প্রার্থী কে হবেন, সেই বিষয়টি পর্যন্ত দেখভাল করেন। এক বিরোধী নেতার দাবি, এমন লোক জেলাশাসক থাকলে আদৌ কি অবাধ ভোট সম্ভব?

রুদ্ধদ্বারে এমন কাঁপুনি ধরানো পর্যবেক্ষকরা কিন্তু ভোটারদের সঙ্গে সহজে মিশে যেতেই চেষ্টা করছেন। উত্তরবঙ্গে যেমন করলেন চন্দ্রভূষণ কুমার। সাবেক ছিটমহলে গিয়ে জনে জনে কথা বললেন। আবার জলপাইগুড়িতে ভোটার সংখ্যা দেখে বুথ বাড়াতে বললেন। একই ভাবে হুগলির ভোট প্রস্তুতি নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে বৈঠকে মন দিয়ে তাঁদের কথা শুনলেন বিবেককুমার সিংহ। তার পর সেই জেলা পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে জানতে চাইলেন, অভিযোগগুলি নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? তিনিই আবার সটান চলে গেলেন শ্রীরামপুরের যোগদানন্দ আশ্রমে। সেখানে কিছু ক্ষণ কাটিয়ে বেরিয়ে পথচলতি মানুষের সঙ্গে কথা বললেন। কেউ চাইলে তাঁদের হাতে দিলেন নিজের ভিজিটিং কার্ড। বললেন, দরকারে সরাসরি পরিস্থিতির কথা জানাতে পারেন।

প্রায় একই ভাবে শনিবার বিকেলে দুই বিশেষ পর্যবেক্ষক জে কে রাও ও সুনীল দত্ত হঠাৎই গাড়ি ঘুরিয়ে হাজির হন খাগড়া বান্ধব প্রেস মোড়ে। সঙ্গে ছিলেন দু’জন লিয়্যাঁজ অফিসার। সেখানে সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে মুর্শিদাবাদ সিল্ক কেনেন এক পর্যবেক্ষক। সেই সূত্রে দোকানির সঙ্গে কিছু কথাবার্তাও বলেন তিনি।

কাজের ফাঁকে স্থানীয় এলাকা ঘুরে দেখার দলে রয়েছেন আর এক পর্যবেক্ষক নরেন্দ্র চৌহানও। পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-বর্ধমান-বীরভূমের দায়িত্বে থাকা এই পর্যবেক্ষক এ দিন হঠাৎই ইলামবাজারের আমখই গ্রামে পৌঁছে যান। অভিযোগ, লোকসভা নির্বাচনে এখানকার মানুষকে ভোট দিতে দেয়নি শাসকদল। তিনি ভোটারদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেন। তার পর নিকটবর্তী ফসিল পার্কও ঘুরে আসেন।

প্রশাসনের একাংশ বলছে, এ ভাবে আসলে দু’টি কাজ করছেন পর্যবেক্ষকরা। এক দিকে এলাকাটি চিনছেন, গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলি দেখছেন। অন্য দিকে, মানুষের কাছেও সহজে পৌঁছতে চাইছেন। রুদ্ধদ্বারে গরম এবং বাইরে নরম এই অবস্থানই ভোটকে সুষ্ঠু ও অবাধ করতে পারবে বলে তাঁদের বিশ্বাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 election commission
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE