Advertisement
E-Paper

জাহাজ-মিনারের স্টেশনে থমকে প্রশ্নেরাও

মাশাআল্লাহ! এত পরিবর্তন! সেই ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ পুলিশের গুলিতে নিহত শেখ ইমদাদুল, সুপ্রিয়া জানাদের দেহ ভাঙাবেড়ার খালের পাড় থেকে কুড়োনোর পরে কাঁপতে কাঁপতে যিনি কালীঘাটে ফোনে খবর দিচ্ছিলেন, এখন তাঁর জাহাজোপম বাড়ির ডেকের গায়ে খোদাই করা ‘মাশাআল্লাহ’ বেশ মানানসই লাগছে।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৬ ০৪:২১
পরিবর্তন! তারাচাঁদবাড়ে তৃণমূল নেতা শেখ সুফিয়ানের প্রাসাদোপম বাড়ি (বাঁ দিকে)। নন্দীগ্রাম রেলস্টেশন যদিও অসমাপ্তই। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

পরিবর্তন! তারাচাঁদবাড়ে তৃণমূল নেতা শেখ সুফিয়ানের প্রাসাদোপম বাড়ি (বাঁ দিকে)। নন্দীগ্রাম রেলস্টেশন যদিও অসমাপ্তই। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

মাশাআল্লাহ! এত পরিবর্তন!

সেই ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ পুলিশের গুলিতে নিহত শেখ ইমদাদুল, সুপ্রিয়া জানাদের দেহ ভাঙাবেড়ার খালের পাড় থেকে কুড়োনোর পরে কাঁপতে কাঁপতে যিনি কালীঘাটে ফোনে খবর দিচ্ছিলেন, এখন তাঁর জাহাজোপম বাড়ির ডেকের গায়ে খোদাই করা ‘মাশাআল্লাহ’ বেশ মানানসই লাগছে। মাস্তুলের উপরে সগর্ব উড়ছে তৃণমূলের পতাকা। হতে পারে, দু’মাস আগে ফেরিঘাটে নেমে হেঁটে যেতে গিয়ে দিদির রাগ হয়েছিল পোড়া জনপদে এমন প্রাসাদ দেখে। রাগ পড়তে আর কত ক্ষণ? মাস্তুলে জোড়া ফুল নিয়ে শেখ সুফিয়ান দিব্যি আছেন!

নন্দীগ্রাম বাজার আর থানার পাশ দিয়ে ১ নম্বর ব্লকের ভিতরে ঢোকার সেই ঘিঞ্জি রাস্তাটা এড়ানোর জন্য বাইপাস হয়েছে। রাস্তা কাটা আর গাছের গুঁড়ি ফেলা ছিল যাদের আন্দোলনের অভিজ্ঞান, তাদেরই এলাকায় প্রতিটা কালভার্টে এখন যত্নের নীল-সাদা রং। কাঠের সেতু পাকা হয়েছে। মোরাম রাস্তায় সব কংক্রিটের ঢালাই। সূর্য ডুবলেই তার উপরে ঠিকরে পড়বে সুউচ্চ স্তম্ভ থেকে এলইডি-র সাদা আলো। পুরনো হাসপাতালের পিছনে নীল-সাদা নতুন বাড়ি তৈরি। সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের তকমা অর্জন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

ভাঙাবেড়ার সেই সেতুর অদূরে মাথা তুলেছে ১৩০ ফুটের শহিদ মিনার। এক কণা জমি দিতে ভয়ানক আপত্তি তুলে পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতেছিল যে নন্দীগ্রাম, ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি গড়ে মাসের পর মাস সশস্ত্র লড়াই চালিয়েছিল তৎকালীন শাসক দলের বাহিনীর সঙ্গে, সেই নন্দীগ্রামই শহিদ মিনার, তার লাগোয়া গেস্ট হাউস, বাগানের জন্য বিঘাকয়েক জমি ছেড়ে দিয়েছে অনায়াসে। এমন আড়ম্বরে শহিদ তর্পণ দেখলে ভবিষ্যতের আন্দোলনের জন্য শহিদ হতে আরও কত প্রাণ নিবেদিত হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই!

সত্যিই তো পরিবর্তন। ক্লান্তিকর রক্তক্ষয়ের জন্য আন্তর্জাতিক শিরোনামে চলে আসা অখ্যাত জায়গাটার ভোল বদলে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঁচ বছরের জমানা। সোনাচুড়ায় পানের দোকানি সেই জন্যই বোধহয় বলে দিলেন, ‘‘বেশি কথা বলতে পারব না। এখন শান্তি আছে।’’

কিন্তু পরিবর্তন দেখে চোখের শান্তি তছনছ করে দেওয়ার জন্যও আর একটা নন্দীগ্রাম আছে যে! ভাঙাবেড়া সেতুর পাশ দিয়ে জংলা আলপথ দিয়ে নেমে গেলে অর্ধদগ্ধ বাড়িটা এখনও দাঁড়িয়ে। সেই ২০০৭-এর জানুয়ারিতে যে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে বল্লমের খোঁচায় তার মধ্যে নিয়ে ফেলা হয়েছিল শঙ্কর সামন্তকে। অভিযোগ ছিল, সিপিএমের ওই পঞ্চায়েত নেতার বাড়ি থেকেই নাকি প্রতিরোধ কমিটির উপরে হামলার ছক হচ্ছিল। পাশের একতলা ছোট্ট বাড়িতে বৈশাখী দুপুরে বিভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে এখনও বসে শঙ্করের বৃদ্ধা মা পঙ্কজ। জানতে চাইছেন, ‘‘শহিদ কি শুধু এক পক্ষের হয় বাবা? আমার ছেলেটা কোথায় বিচার পেল?’’

এ প্রশ্নের উত্তর হয় না জেনে হাজরাকাটা হয়ে চৌরঙ্গিবাজারের ভাঙা-ধসা আর এক বাড়িতে পৌঁছতেই আবার প্রশ্ন। ‘‘আমার জীবনটা তো খেয়ে ফেলেছিল ওদের একটা ছেলে (শঙ্কুদেব পণ্ডা)। এ বার নারদে কী হল? ঘুষের শাস্তি হবে না? ইস্তফা দেবে না কেউ?’’ জানতে চাইছেন ইলিয়াস মহম্মদ। নন্দীগ্রামের প্রাক্তন সিপিআই বিধায়ক। ন’বছর আগে ছোট একটা স্টিং অপারেশন যাঁর জীবন থেকে যাবতীয় প্রাণ শুষে নিয়ে চলে গিয়েছে! সাদা দাড়ি, ঝুল পাঞ্জাবির এই ইলিয়াসের সামনে বসলে পুরনো সেই নন্দীগ্রাম, বিধানসভার পুরনো সব লড়াই এক লহমায় চোখের উপরে ভিড় করে আসে। এই লোকটাই সেই লোকটা? পাশে বসে সিপিআইয়ের স্থানীয় কর্মী শেখ সাদ্দাম অবশ্য প্রত্যয় ফিরিয়ে দেন, ‘‘শাস্তি হবে বাবা। দেখো শাস্তি হবে। ভোটে যদি না-ও হয়, আদালতে হবে।’’

ভোট বলতে মনে পড়ল, নন্দীগ্রাম ভোট দেবে বৃহস্পতিবার। আসলে দিতে হয়, তাই দেবে। যারা উন্নয়নে মাস্তুল তুলে আছে আর যারা বিচার না পাওয়ার অভিমানে আছে, তাদের কারওরই ভোট নিয়ে কোনও উৎসাহ নেই! গোটা নন্দীগ্রাম জুড়ে বাড়ির পাঁচিল থেকে গাছের ডালে একটাই নাম শুধু ঝুলে আছে। নন্দীগ্রামের ‘নিজের লোক’ শুভেন্দু অধিকারীকে ভোট দিন। কে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, কী তাঁর প্রতীক, নন্দীগ্রাম ঘুরলে এ সব জানার উপায় নেই!

প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু এক জন আছেন। সিপিআইয়ের কবীর মহম্মদ। বাম কর্মীরা বলছেন, এই নন্দীগ্রামে পোস্টার-পতাকা লাগাতে গিয়ে ধরা পড়া অবধারিত এবং তখন জুটবে মার। তার চেয়ে মানুষ বুথে গিয়ে চুপচাপ ভোটটা দিন। আর রেয়াপাড়ায় প্রচারের ফাঁকে সিপিআই প্রার্থী বলছেন, ‘‘চলার রাস্তা আগেও ছিল। এখন আরও ঝকঝকে হয়েছে। কিন্তু মানুষ কথা বলার অধিকার পেয়েছে কি? আমার কথা না মানলেই দেখে নেব, এই নীতিতে কালীঘাটের দিদির সঙ্গে অধিকারী-রাজের তো কোনও ফারাক নেই!’’

তৃণমূল প্রার্থী, নারদ-বিদ্ধ (যদিও এখানে নারদের তেমন প্রচার নেই) শুভেন্দু আবার পাল্টা জানতে চাইছেন, ‘‘ফারাকটা নিজেই বুঝে নিন! দেখলেন তো নন্দীগ্রাম কী ছিল আর কী হয়েছে!’’ কিন্তু লোকে কি কথা বলতে পারছে? পূর্ব মেদিনীপুরের যুবরাজের জবাব, ‘‘কেন পারবে না? উন্নয়ন একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। মানুষের চাহিদা বাড়বেই। কিন্তু একটা কথা বলতে পারি। নন্দীগ্রাম ভাল আছে।’’

শুনে মনে পড়ে গেল নন্দীগ্রাম স্টেশনের সেই ধু-ধু ছবিটা! প্ল্যাটফর্ম আছে, ওভারব্রিজ আছে, টিকিট কাউন্টার আছে, স্টেশন আধিকারিকদের ঘর আছে, রেলের কোয়ার্টার আছে। শুধু রেললাইনটা আসেনি।

ট্রেনের ভার যে স্টেশনকে নিতে হয় না, তার চেয়ে ভাল আর কে আছে!

assembly election 2016 Nandigram
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy