Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Goutam Deb

Bengal polls: মাঠ ছাড়েনি ঘাসফুল, তবে ডান হাতে ব্যথা

দু’বারের জেতা আসন কঠিন করে তুললেন কে? শিখা চট্টোপাধ্যায়। গৌতমেরই অন্যতম ডান হাত ছিলেন।

বড়দিঘি চা-বাগান এলাকার ছাওয়াফুলি গ্রামে প্রচারসভা।

বড়দিঘি চা-বাগান এলাকার ছাওয়াফুলি গ্রামে প্রচারসভা। নিজস্ব চিত্র।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৫০
Share: Save:

‘আসছ তুমি আবার, এই নিয়ে তিন বার’। জলপাইগুড়ি জেলার একমাত্র অসংরক্ষিত আসন ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির ১৩টা ওয়ার্ড শিলিগুড়ি পুরসভায় পড়ে। সেখানেই দেয়ালে দেয়ালে নজর টানছে তারকা-প্রার্থী, রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেবের প্রচারলিখন। অথচ এই আসনেই লোকসভার নিরিখে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে তৃণমূল। ব্যবধান প্রায় ৮৪ হাজার। পারবেন পুষিয়ে নিতে? মন্ত্রী চেষ্টার কসুর করছেন না। এর মধ্যেই ৫০০ কিলোমিটার চষে ফেলেছেন। শিলিগুড়ির তিনবাত্তি মোড়ে যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হল, তিনি দরজায় দরজায় ঘুরছেন। বললেন, ‘‘আমাকে শিলিগুড়ি থেকে দাঁড়ানোর প্রস্তাবও দিয়েছিল দল। আমি কঠিন আসনই নিলাম।’’

দু’বারের জেতা আসন কঠিন করে তুললেন কে? শিখা চট্টোপাধ্যায়। গৌতমেরই অন্যতম ডান হাত ছিলেন। ২০১৭-য় মুকুল রায়ের সঙ্গে দল বদল, এ বার বিজেপির প্রার্থী। বস্তুত জলপাইগুড়ি জুড়েই ডান হাতের ব্যথা ভোগাচ্ছে তৃণমূলকে। তা বাদে জেলার ৭টি আসনে লোকসভায় ৬-১ পিছিয়ে পড়া শাসক দল লড়াইয়ে আছে। হারানো জমি ফিরে পেতে ঝাঁপাচ্ছে।

জয়ের স্বাদ পেয়ে যাওয়া বিজেপি শিবিরেও উদ্দীপনা কম নয়। শিখা আত্মবিশ্বাসী সুরে বলেন, ‘‘প্রতিপক্ষ হেভিওয়েট কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন আমার সঙ্গে আছে।’’ ফুলবাড়ি-২ ব্লকের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে তাঁর প্রচারে তেমন স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া চোখে পড়ল না যদিও। তবে কর্মীরা নিজেরাই বললেন, এটা তাঁদের এলাকা নয়। ফুলবাড়ি ১ থেকে ভাল ফল আশা করছেন।

‘রাজ্যে শিল্প নেই বলেই পরিযায়ীদের কষ্ট পেতে হল লকডাউনে! এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার।’ বামেদের গলা? না, বেলাকোবায় বিজেপি প্রার্থী সুপেন রায়ের সমর্থনে সভা থেকে মাইকে ভেসে আসছে কথাগুলো। এলাকার বনেদি মিষ্টির দোকান জানাল, রাজগঞ্জ আসনে এ বার হাওয়া নাকি হিন্দুত্বের। তাই? লোকসভা ভোটে জেলায় এই একটি আসনেই তো এগিয়েছিল তৃণমূল। লড়াই তো সহজ হওয়ার কথা! আবার সেই ডান হাত! শোনা যায়, এ বার টিকিট-প্রত্যাশী ছিলেন দলের জনজাতি-ওবিসি সেলের প্রধান কৃষ্ণ দাস। এলাকার ভোট-ভাগ্যের অনেকখানি নিয়ন্তা তিনিই। কিন্তু টিকিট পেলেন বিধায়ক খগেশ্বর রায়। সুধামগঞ্জের মাঠ পেরিয়ে একটু এগিয়ে পাওয়া গেল খগেশ্বরকে। দলীয় কর্মীদের নিয়ে মিটিং করছেন। পাশেই বসে কৃষ্ণ। দু’জনের মিলমিশের উপরে দুলছে রাজগঞ্জে ঘাসফুলের ভাগ্য!

ধূপগুড়িতেও বিধায়ক-প্রার্থী মিতালি রায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দলেরই একাংশের। ভোট ময়দানে তাঁদের পূর্ণ সমর্থন মিলবে কি? প্রতিপক্ষ কিন্তু আরএসএস-এর পোড় খাওয়া সংগঠক বিষ্ণুপদ রায়। লড়াই কঠিন। ধূপগুড়ি গ্রামীণের পার্টি অফিসে কামতাপুরী আন্দোলন করে উঠে আসা মিতালির সঙ্গে যখন দেখা হল, বললেন, ‘‘সারা বছর যেমন সকাল-সন্ধে ঘুরি, তেমনই ঘুরছি।’’ অল্প দূরেই শনিবাসরীয় হাট। হাটুরেরা জানালেন, তাঁদের বাজি মিতালিই।

চা-বাগান অধ্যুষিত নাগরাকাটা আর মালবাজার আসন দু’টিও তৃণমূল শিবির কঠিন ঠাঁই হিসেবে ধরেছে। বাগান এলাকা এক সময়কার লাল দুর্গ। ২০১৩-য় জেলা পরিষদ পেয়েও ধরে রাখতে না পারার পর থেকে ধসের শুরু। অন্য দিকে তৃণমূলের একারই চার-চারটি ইউনিয়ন, অতএব দ্বন্দ্ব অহর্নিশ। এই দু’টো সুযোগই পূর্ণমাত্রায় নিয়েছে বিজেপি। বিশেষ করে ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটের অভিজ্ঞতার পরে বাম ভোট সটান পা বাড়িয়েছে পদ্মবনে। এ বার কি সেই ভোট ঘরে ফিরবে? নাগরাকাটায় কংগ্রেসের সুখবীর সুব্বা, মালবাজারে সিপিএমের মনু ওঁরাও তো বটেই, রাজগঞ্জে রতন রাই, ডাবগ্রামে দিলীপ সিং, ধূপগুড়িতে প্রদীপকুমার রায় কিংবা ময়নাগুড়িতেও নরেশচন্দ্র রায়ের মতো বাম প্রার্থীদের উপস্থিতি এ বার নির্ণায়ক হতে পারে। ভোট ফেরাতে না পারলে তাঁদের অস্তিত্ব নিয়ে
যে প্রশ্ন উঠে যাবে, বুঝছেন বাম নেতৃত্বের একাংশ। বাকিরা বুঝছে কি? চাইলেই যে ভোট ফিরবে, সে নিশ্চয়তাই বা কতটুকু?

কিছুটা ফিরবে নিশ্চিত, বলছেন মালবাজারের বিধায়ক-প্রার্থী তৃণমূলের বুলুচিক বরাইক। তাঁর বিপরীতে বিজেপির মহেশ বাগে। বুলুচিক নিজে সিপিএম প্রাক্তনী। ২০১৪-র পর থেকে তৃণমূলে। বুলুচিকের প্রতি দলের সবাই খুশি নয়। তেমনই এক ‘অখুশি’ নেতা হীরামন ওঁরাওয়ের ‘মান ভাঙিয়ে’ ফেরার পথেই নেপুছাপুর বস্তি এলাকায় কথা হচ্ছিল বুলুচিকের সঙ্গে। বললেন, ‘‘এই শেষ ভোট। সিটটা দিদিকে দিতে চাই।’’ মিতালি আর বুলুচিক, দুজনেই মানলেন, ২০১৯-এ প্রচারে ঢিলেমি ছিল। এ বার তা থাকবে না। কিন্তু ঘরশত্রু? জল মেপে বাইরে পা বাড়িয়ে থাকার প্রবণতা? সে রোগ যাবে কোথায়!

নাগরাকাটায় দলের ভিতরের অসন্তোষ অবশ্য কিছুটা বেরিয়ে গিয়েছে বিধায়ক শুকরা মুন্ডা দল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ায়। কিন্তু টিকিট মেলেনি। দলবদলুর বদলে বিজেপি ভরসা রেখেছে আরএসএস-এর পোনা ভেংগ্রার উপরে। চা-বাগানের ভূমিপুত্র পোনা অবসরপ্রাপ্ত বিএসএফ জওয়ান। গুজরাতে কর্মরত থাকার দিনগুলি থেকেই নরেন্দ্র মোদীর ভক্ত। ‘ভারতমাতা কি জয়’ ধ্বনি তুলে নিজের জয়ের ব্যাপারে একশো শতাংশ আশাবাদী। নাগরাকাটা বাজার আর স্টেশন চত্বরে ঘুরে দেখা গেল, সকলেই বলছেন, টক্কর জোরদার। ইস্টারের রবিবারে জলঢাকা সেতু পার করে স্থানীয় গির্জায় উপচে পড়া ভিড়। হিন্দুত্বের দাপাদাপি যত বাড়ছে, অস্বস্তি বাড়ছে ওঁদের। তৃণমূলের খ্রিস্টান প্রার্থী জোসেফ মুন্ডা প্রচারে আসতেই অভ্যর্থনা পেলেন। জোসেফের দাবি, খ্রিস্টান ভোট তো বটেই, গোর্খা ভোটও এ বার বিমল গুরুংয়ের সৌজন্যে তৃণমূল পাবে। অ-খ্রিস্টান আদিবাসীদের ভোটও ফিরবে।

ফিরবে? জঙ্গলমহলে অর্জিত আত্মবিশ্বাসে বিজেপি তা মনে করে না। জলপাইগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গের মাটি এখন তাদের কাছে ভারী উর্বর। জেলা জুড়ে নিত্যনতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা, নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সঙ্ঘের পুরনো সংগঠন ক্রমশ আড়েবহরে বাড়ছে। ও-পার থেকে আসা বাঙালিদের পুরনো ক্ষত খুঁচিয়ে দিচ্ছে মেরুকরণের প্রচার। রামমন্দিরের জন্য শুধু এই জেলা থেকেই চাঁদা গিয়েছে সাড়ে তিন কোটি টাকা! তারই সঙ্গে রাজবংশীদের একাংশ লালন করছেন পৃথক রাজ্যের স্বপ্ন।

এতদসত্ত্বেও লোকসভার অঙ্ক পুনরাবৃত্তির আশা দেখছে না বিজেপি শিবিরই। মূলত প্রার্থী নিয়ে বিক্ষোভই তার কারণ। যেমন, ময়নাগুড়ির কৌশিক রায়। প্রায়ই কীর্তনের দল নিয়ে বেরোচ্ছেন, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন প্রবীণদের। কিন্তু তাঁকে ঘিরে বিতর্ক কম নয়। খোদ বিজেপিই তাঁকে সাসপেন্ড করেছিল। তার পর থেকে তিনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মী। এই আসনে বর্তমান বিধায়ক অনন্তদেব অধিকারীর বদলে মনোজ রায়কে টিকিট দিয়েছে তৃণমূল। পঞ্চায়েতের দাপুটে নেতা, এলাকা চেনেন হাতের তালুর মতো। সন্ধে নামার পরেও পুঁটিমারির মাঠে তাঁর সভায় ঠাসা ভিড়। ময়নাগুড়ি নিয়ে তাই আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে না গেরুয়া শিবিরকে।

জলপাইগুড়ি সদরেও বিজেপির জেলা সহ সভাপতি দীপেন প্রামাণিক টিকিট পেলে অঙ্ক অন্য রকম হত, কবুল করছে সব দল। হতাশায় নিজেরাই পার্টি অফিসে আগুন দিয়েছিলেন বিজেপি কর্মীরা। সৌজিত সিংহের মতো আনকোরা মুখ তাঁরা চাননি। পুরনো ঘাঁটিতে কংগ্রেস এ বারও দাঁড় করিয়েছে সুখবিলাস বর্মাকে। কিন্তু অভিযোগ, তাঁকে এলাকায় পাওয়া যায় না। সুখবিলাসের দাবি, তিনি মাসে ৭-৮ দিন আসেনই। করোনার সময় আটকে গিয়েছিলেন। কিন্তু অফিস খোলা ছিল। এই আবহে নিজের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটা বাড়িয়ে নিচ্ছেন তৃণমূলের চিকিৎসক প্রার্থী, এলাকার পরিচিত মুখ প্রদীপকুমার বর্মা। প্রথম বার ভোটে দাঁড়ালেও তাঁর উপরে বাজি ধরছেন অনেকেই।

বাগিচায় এখন ফার্স্ট ফ্লাশের মরসুম। তিস্তা রুখুশুখু। কানে বাজছে গড়ালবাড়ির সভায় সুখবিলাসের গানের কলি, দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙ্গিলা দালানের মাটি! অনিত্য সংসারে অনিত্যতর ভোট!কার দালান কবেই বা অটুট থেকেছে চিরকাল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE