Advertisement
E-Paper

রাতভর প্রোগ্রাম, পকেটে দেড়শো টাকা, হাতে চারটে লুচি— এভাবেই তো মানুষ গড়ে ওঠে

জীবনে অভিজ্ঞতার প্রকাশ করতে গিয়ে নিজেকে উন্মোচনের তাগিদে শিল্পীকে কলম ধরতে হয়। সে ক্ষেত্রে একটা দাবি তৈরি হয় বাইরে থেকে। আর এই কলম ধরতে বসে কী দিয়ে শুরু করি ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময়ই কেটে যায়, তবু গুছিয়ে নেওয়া হয়ে ওঠে না। সবটাই রঙিন-ধূসর মিশ্রিত।

সতীশ সাউ (নাট্য অভিনেতা ও পরিচালক)

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৬ ১৬:১২
নাটকই লেখকের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।

নাটকই লেখকের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।

জীবনে অভিজ্ঞতার প্রকাশ করতে গিয়ে নিজেকে উন্মোচনের তাগিদে শিল্পীকে কলম ধরতে হয়। সে ক্ষেত্রে একটা দাবি তৈরি হয় বাইরে থেকে। আর এই কলম ধরতে বসে কী দিয়ে শুরু করি ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময়ই কেটে যায়, তবু গুছিয়ে নেওয়া হয়ে ওঠে না। সবটাই রঙিন-ধূসর মিশ্রিত। চলার পথ যে খুব মসৃণ তা একেবারেই না। তাই হোঁচট খেয়ে রক্ত ঝরিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলোই মঞ্চের ওপর স্ফূরণ করতে করতেই যেন নাটক হয়ে ওঠে। আর এই অভিজ্ঞতা শব্দটা একজন হিন্দিভাষী বাঙালি অভিনেতার কাছে এতটাই জীবন্ত সেটা লিখতে বসে বার বার ফিরে যাই আমার প্রিয় শহরে। আমার শহর, আমার আশপাশের মানুষজন যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার দিকে। যাদের ছাড়া এই সতীশ সাউ কোনও দিন স্বপ্রতিভায় মানুষের মনে দাগ কাটতে পারত না। স্মৃতির নৌকা কোথাও কালপ্রবাহকে অনুসরণ করে, কোথাও সযত্নে আলপনা এঁকে যায়।

অন্নসূত্রে উত্তর হাওড়ার সালকিয়াতে আমার ছোটবেলার দিনগুলি কেটেছে দাদু, বাবা-মা, দাদাদের সঙ্গে। মাতৃভাষা হিন্দি তাই লেখাপড়া কথাবার্তা সবটাই হিন্দি কেন্দ্রিক। তবে আমার দাদু ছিলেন একেবারে অন্যরকম। বলা চলে তিনি বাঙালি প্রেমী মানুষ ছিলেন। বাড়িতে এক এক দিন দাদুর বন্ধুবান্ধবদের আড্ডার আসর জমত যেখানে, অধিকাংশই ছিলেন বাঙালি। দাদুর একজন বিশেষ বন্ধু শৈল মুখোপাধ্যায় আসতেন আমাদের বাড়িতে। আর সেই সময় থেকেই বাংলার প্রতি ঝোঁক তৈরি হতে থাকে।

পড়াশোনায় বরাবর ক্লাসে লাস্ট বেঞ্চের ছাত্রই ছিলাম। খুব ইন্টারেস্ট পেতাম ক্লাসে বেঞ্চ বাজিয়ে গাইতে। যদিও না জানি এখন কত বাদ্যযন্ত্রের প্রেমে পড়েছি। মিমিক্রি করা আর পাড়ার জলসায় এক অনামী ঘোষকের ভূমিকায় প্রোগ্রাম সঞ্চালনা, মনে পড়ে কোনও এক হিন্দি ব্যান্ডের দলে নাম লিখিয়ে রাতভর প্রোগ্রাম করে পকেটে ১৫০ টাকা আর হাতে গুঁজে দেওয়া চারটে লুচি আলুরদম যে কতখানি শিঁরদাঁড়া শক্ত করে তা বেশ টের পাই। বোধহয় এভাবেই মানুষ গড়ে ওঠে।

ইতিহাসের সালের চুলচেরা বিষয় নিয়ে না ঘেঁটেও কিছু ঘটনা বেশ মনে পড়ছে। পাড়ায় কজন বন্ধু মিলে ‘বিদ্রোহী তরুণ সঙ্ঘ’ ক্লাব গঠন করি। সারা বছর ক্লাব চালানোর জন্য বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, রবীন্দ্র-নজরুল অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে রক্তদান শিবির গঠন সবেরই আয়োজন করতে থাকি। তখন তরুণ বয়স, অস্বীকার করব না, দু’এক বার প্রেমেও পড়েছি। আর সেই প্রেম শেষ কালে কনে-যাত্রীতে পরিণত করেছে। জীবনে এর চাইতে বড় উপহার আর কী হতে পারে।

এই ভাবে চলতে চলতে এক সময় কলকাতার হাত ধরি। বরং এই দেখলাম বিশেষ প্রেমিকার মতো হাতটি ধরে রেখেছে এখনও। মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসে ফেললাম শহরটাকে, আর সে আমাকে। তখন ৯৯ সাল। অবাঙালি থেকে বাঙালিবাবু হয়ে ওঠার দিন শুরু হয়। নিজের মধ্যে যে ছোট ছোট হাতিয়ারগুলো ছিল একে একে সব বেরিয়ে পড়তে শুরু করে। হাতেখড়ি হয় ‘চেতনায়’ দিলীপ সরকারের হাত ধরে। বুঝতে শিখলাম গ্রুপ থিয়েটার কাকে বলে। কেন গ্রুপ থিয়েটার প্রয়োজন। গ্রুপ থিয়েটার করার কী কী উদ্দেশ্য। যদিও আজ এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই এক অদ্ভুত ভাঙন। সেই কনসেপ্ট এখন আর খাটে না। গ্রুপ থিয়েটার থেকে দলের শুধু নাটক করাই নয়, দলের সমস্ত কাজ করা, দলের কর্তাব্যক্তিদের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা। খুব মজা হত যখন সবাই মিলে নাটক দেখতে যাওয়া হত। কারণ নাটক করার পাশাপাশি নাটক দেখাও খুব জরুরি। এ ছাড়া প্রচুর বই পড়া। এই বই পড়া এখন স্বাভাবিক কিন্তু আগে বেসামাল ছিলাম। তবে প্রাণপণ চেষ্টা করতাম তাড়াতাড়ি তৈরি হতে। প্রচুর ছোট ছোট গল্পের বই পড়তাম যেমন নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দ্য গ্রেট, আবোল তাবোল, পাগলা দাশু, এমনকী পথচলতি পোস্টারও। সেই সময় যে নাটকগুলো খুব দেখতাম যেমন মেঘনাদ ভট্টাচার্যের দায়বদ্ধ, বাসভূমি, মনোজ মিত্রের সুন্নি ও সাতচৌকিদার, মাধব মালঞ্চ কইন্যা। বুঝতে পারতাম পাড়ায় জলসার নাটক আর এই নাটকের ফারাকগুলো। একটা নাটক করতে গেলে কত রকমের ভাবনাচিন্তা, আলো, শব্দ, মঞ্চসজ্জা, মেপআপ, কস্টিউম— এই গোটা ব্যাপারগুলো কিছুই জানা ছিল না। ধীরে ধীরে যত শিখছি ততই বুঝতে পারতাম এক প্রকাণ্ড প্রতিযোগিতার বাজারে নিজের নামটি লিখিয়ে ফেলেছি। তার পর দেখতে দেখতে কটা বছর কেটে গেল। পানাপুকুর থেকে সমুদ্রে যখন এসেই পড়েছি তখন জীবদ্দশায় সমুদ্রেই ভাসব ঠিক করলাম। তখন মনে হত ‘ইউহি কাট জায়েগা সফর সাথ চলনে সে/কে মনজিল আয়েগি নজর সাথ চলনে সে।’

বিভিন্ন সময় অনেক বিশিষ্ট মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি। তবে এই মানুষটার সাহচর্য ছাড়া অভিনেতার এই সার্থক পরিচয় আজ বহন করতে পারতম না। তিনি ছিলেন অরুণ মুখোপাধ্যায়। যাঁর নির্দেশনায় ‘জগন্নাথ’, ‘মারীচ সংবাদ’ নাটকে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাই। এরও পরে আরও একজন জীবনে আসেন তিনি ছিলেন সুমন মুখোপাধ্যায়। তাঁর সান্নিধ্যে আমি ভাল বাংলা বলা শিখেছি। তাঁর নির্দেশনায় ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, সময় অসময় বৃত্তান্ত, কালান্তক, লালফিতা, ফাল্গুনী-র মতো নাটকে অভিনয়। তার পর টার্নিং পয়েন্টে এসে দাঁড়ায় দেবেশ চট্টোপাধ্যায়-এর নির্দেশনায় কাঙাল মালসাট, আর ফ্যাতাড়ু-তে। এই নাটকগুলি মঞ্চস্থ হলে এখনও প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হয়ে ওঠে। এর পর কৌশিক করের নির্দেশনায় ‘পর্ণমোচী’-তে পানুদা চরিত্র, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় হাবিব তনবীরের ‘চরণদাস চোর’ নাটকে চরণদাস চরিত্রে অভিনয় করছি। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই আজ সতীশ সাউ-এর নামে হলে দুটো হলেও টিকিট বিক্রি হয়। মানুষ পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে নাটক দেখতে আসে এই অভিনেতার অভিনয়ের টানে। নাট্য জীবনের শুরুতে মহেশ জয়সওয়ালের নির্দেশিত একটি নাটকে অভিনয় করি। যেটা গোটা দিল্লি, মুম্বই জুড়ে ৫০০ টার বেশি শো করে।

নাটক যখন খাদ্যের জোগান দিতে শুরু করে তখন দায়িত্ব আসে সমাজের প্রতি, নাটকের দলগুলির প্রতি। তবুও কিছুটা দুঃখ, বেশ খানিকটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। ভাবতে খারাপ লাগে যেখানে ভাল কাজের চাহিদা আছে, সেখানে কেন কলকাতা পিছিয়ে গেল! কেন একটা ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা তৈরি হল না! আজকাল যে সব ছেলে মেয়েরা দলগুলিতে আসছে তারা যা কাজ করছে সেখানে খুব অনায়াসেই একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি হতেই পারত। সেটা আজ আমাদের হাতের বাইরে চলে গেছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এটুকু বলতে পারি যে সব দলের প্রতিটি ছেলেমেয়েদের প্রতি দায়ভার আছে। নাটককে কেন্দ্র করে আজ বহু মানুষের পেট চলে, সেখানে একটা দায়িত্বের কথা এসেই যায়। এমনই ভাবনাচিন্তা নিয়ে ‘ধুলাউড়ানিয়া’ নামে একটা দল গঠন করি, যেটা শুধুমাত্র কলকাতা নয় সুদূর পুরুলিয়া বীরভূমে পথশিশুদের নিয়ে পথনাটিকা করছে। শুধুমাত্র অভিনয়টুকু নিয়েই নাটক নয়, এর মধ্যে আছে চরিত্রগঠন, নিয়মানুবর্তিতা, যা একটা মাটির দলকে আশা দেয়। একা বাঁচা বা একা পথচলা সেটা একজন শিল্পীর পক্ষে হয়ে ওঠে না। সবটাই দেনা-পাওনার আকারে চলতে থাকে। এই শহর যেমন দিয়েছে তেমন ভাবেই শহরের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আরও অনেক সতীশ সাউ বেঁচে থাক এমনটাই চাই। আরও একটা স্বপ্ন দেখি, যে দিন থাকব না সে দিন আমার চোখ দিয়ে কেউ দেখুক, আমার কিডনি দানে আরেক জনের প্রাণ বাঁচুক। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটা লাইন। যেটা বাংলা শিখতে গিয়ে পড়েছিলাম— ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী/ আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy