প্রশ্ন: কত বছর পরে একক সাক্ষাৎকার?
নুসরত: ঠিক মনে পড়ছে না। তবে বহু বছর পরে এমন সাক্ষাৎকার দিচ্ছি।
প্রশ্ন: এই নুসরত পরিণত...
নুসরত: একেবারেই। পাঁচ বছর আগের আমি, আর এখনকার আমির মধ্যে বিস্তর ফারাক। এখন আর পার্টিতে যাই না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিই না। বাড়ি আর কাজ। আমি একঘেয়ে হয়ে গিয়েছি। এই একঘেয়েমি আমার কাছে অবশ্য ‘ইন্টারেস্টিং’। তবে, একটা কথা বলি, এই পরিবর্তিত নুসরত অনেক কিছু যশের থেকে শিখেছে। এ মা! আমি তো ওকে ‘ওয়াইডি’ বলি। যশ বলছি কেন?
প্রশ্ন: কী শিখলেন যশের কাছ থেকে?
নুসরত: যশ সাক্ষাৎকারে নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশি কথা বলে না। খেয়াল করে দেখেছি সেই জায়গায় আমি একসঙ্গে অনেক কিছু বলে ফেলি। ব্যক্তিজীবনের কথাও থাকে। পরবর্তী সময়ে কী বলব আর কী বলব না, সেটা ওর থেকে শিখেছি।
যশের থেকে কী কী শিখেছেন নুসরত? ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: আপনি বলছেন আগে ভেবেচিন্তে কথা বলতেন না।
নুসরত: অনেক ক্ষেত্রে আমার যা মনে হয়েছে, তাই বলেছি। তখন কিছুতেই কিছু যেত-আসত না। হিতে বিপরীতও হয়েছে। আগামী দিনেও হতে পারে। তার জন্য মানুষের থেকে অনেক কুকথা শুনতে হয়েছে। শুনেওছি।
প্রশ্ন: মেয়েদের কি একটু বেশি এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়?
নুসরত: মেয়েদের জন্য নিয়ম আছে। বিধিনিষেধ আছে। বহু বছরের সামাজিক ব্যবস্থা। এটা আর কিছু করা যাবে না। তবে, মেয়েরাও ইদানীং আওয়াজ তুলছে। কী যেন বলে... শব্দটা মনে হয় ‘ফেমিনিস্ট’। বর্তমানে মেয়েরা যে ভাবে নিজেদের জীবন চালনা করতে চায় সে ভাবেই কিন্তু করছে।
প্রশ্ন: উচ্চাভিলাষী মহিলাদের বিয়ে করা কি উচিত? অনেক সমঝোতা করতে হয়।
নুসরত: সমঝোতা বা কম্প্রোমাইজ় শব্দটায় বিশ্বাস করি না। প্রত্যেক মানুষকেই সম্পর্কে জড়ালে সমঝোতা করতে হয়। একদিকে ঘেঁটে অন্য দিক সাজাতে গেলে কোনও মানুষই ভাল থাকে না। আর নিজে ভাল না থাকলে পরিবার বা কাছের মানুষকে খুশি করা যায় না। নিজেকে সময় দিতে হয়।
প্রশ্ন: মায়েদের নিজস্ব পরিসর থাকা উচিত?
নুসরত: অবশ্যই।
প্রশ্ন: ভারসাম্য রাখেন কী ভাবে?
নুসরত: শুধু ছেলে নয়। একটা গোটা সংসার সামলাতে হয় আমাকে। আপনাকে বুঝতে হবে, বাড়িতে তো আমি নায়িকা নই। সব খেয়াল রাখতে হয়। কতটা চাল লাগবে, এই তেল শেষ হয়ে গেল, কী রান্না হবে? ছেলে কী খাবে...
প্রশ্ন: এই এত কিছুর খোঁজ রাখেন আপনি?
নুসরত: অবশ্যই, রাখতে হয়। রাখতে হবে। আমি বাধ্য। দেখুন, আমি কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। এই সব কিছু পরিবারের থেকেই শিখেছি । সংসারে বাজেট করে চলতে হয়। মা শিখিয়েছিল। ছেলে কোনটা কখন খাবে, কী পরবে— সব আমি বলে দিই। আমার মধ্যে কিন্তু ‘হেলিকপ্টার মম’ সিনড্রোম আছে। জানি এটা ভাল নয়।
শত ব্যস্ততার মাঝে ছেলেকে সব সময় নজরে রাখেন নুসরত। ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন: আপনি আর যশ অভিনেতা, ছেলে বুঝতে পারে?
নুসরত: হ্যাঁ। আমার ছেলে সব বোঝে। ওকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে মাম্মা, পাপা কোথায় যাচ্ছে? ও বলবে, শুটিংয়ে। নিজেও বলে কাজে যাবে। বলে, ও শুটিং করবে।
প্রশ্ন: যশের প্রথম পক্ষের একটি ছেলে আছে। সম্পর্কের শুরুতে সেই সমীকরণটা কী ভাবে তৈরি করলেন?
নুসরত: এখানে আলাদা করে সমীকরণ বা গ্রহণযোগ্যতার কোনও প্রশ্ন নেই। যশের বড় ছেলে খুব ভাল। ওরা দুই ভাই। একসঙ্গে থাকে, ঘুমোয়। এমন অনেক সময় হয়, আমরা শুটিংয়ে গেলে বলে যাই, ভাইকে দেখে রাখিস। আমাদের দেরি হবে। ও দায়িত্ব নিতে জানে। আমার ছেলে, যশের বড় ছেলে, আমরা, একটা পরিবার তো!
প্রশ্ন: অনেকেই সম্পর্কগুলো এত সহজ ভাবে নিতে পারে না।
নুসরত: যশের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর সময়েই আমি জানতাম, যশ এক সন্তানের বাবা। হ্যাঁ, পরিস্থিতি বুঝতে, চিনতে সময় লাগে। সেই সময়টা নিয়েছিলাম। এখন আমরা ভাল আছি।
মধ্যবিত্ত শিক্ষাগুলো এখনও ভুলতে পারেননি অভিনেত্রী। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশের বিয়ের প্রতিই আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। আপনার আছে?
নুসরত: ওই যে বললাম, মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি। বিয়ের প্রতি আস্থা থাকবে না! হ্যাঁ, একসময় খবর হয়েছিল নুসরত বিয়ে করে বলেছে বিয়ে করেনি। আগে কোনও দিন এই বিষয়ে কথা বলতে চাইনি। আজ বলছি। আমায় ভুল বোঝা হয়েছিল। আমি কিন্তু এই কথা এক বারও বলিনি। আমি কি মূর্খ? বিয়ে করে সংসদে গিয়ে ঘোষণার পরে বলব বিয়েটাই হয়নি! তা হলে আমার পাগলাগারদ থেকে ঘুরে আসা উচিত ছিল।
প্রশ্ন: এটাই তো ছড়িয়েছিল নুসরত!
নুসরত: অতীত খুঁড়তে চাই না। তবে পরিষ্কার করতে চাই সব ধোঁয়াশা। ওদের তরফ থেকে আইনি চিঠি এসেছিল। যেখানে বলা হয়েছিল, আইনসিদ্ধ বিয়ে নয় বলে এটাকে বিয়ে হিসেবে ধরা হবে না। এই কথাটাই হয়তো আমি সঠিক ভাবে মানুষকে বোঝাতে পারিনি। এত কিছু হল, গোটা ভারত যা দেখল সেটা সত্যি নয়, তা আমি কী করে বলতে পারি! এটা বলিওনি। আইনসিদ্ধ হোক বা না হোক বিয়ে তো করেছিলাম।
প্রশ্ন: কেন রেজিস্ট্রি করলেন না?
নুসরত: সময় ছিল না। বাইরে বিয়ে হয়েছিল। ফিরেই সংসদে শপথ নেওয়ার কথা ছিল। একের পর এক কাজের মাঝে সময় বয়ে গিয়েছিল। আমারই ভুল! পাঠককে পুরো বিষয়টা আমি বুঝিয়ে বলতে পারিনি। এটা তো ঠিক, অতীতকে জীবন থেকে কোনও দিন মুছে ফেলতে পারব না।
প্রশ্ন: রাজনীতি থেকে কি নিজেই সরে এলেন, নাকি বাধ্য হয়েছিলেন?
নুসরত: জানেন, নিজের একশো ভাগ দিয়েছিলাম। সেই সময়, নির্বাচনের ঠিক ছ’মাস আগে অনেক বড় কাণ্ড হল। অনেক অভিযোগ করা হল। বলা হল, আমি মানুষকে ঠকিয়েছি! মানুষকে ঠকাতে যাব কেন? আশ্চর্য! পরিণত নুসরত জানে, সে দিন কেন ওই কথা বলা হয়েছিল। দেখুন,আমি এই রেষারেষির মধ্যে আর পড়তে চাইনি। গোটা পরিস্থিতি একা সামলেছি। যশ তখন মুম্বইয়ে। ঈশান ছোট। ঈশানকে দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আর নয়। কিছু দিন পরে ছেলে তো বড় স্কুলে যাবে। ওর নিজের জগৎ তৈরি হবে। চাই না,আমার জন্য ওর উপর কোনও প্রভাব পড়ুক। ২০১৭ সালে টাকা ফেরত দেওয়ার পর ২০২৩ সালে হঠাৎ আমার দিকে আঙুল তোলা হল কেন? সেন্ট্রাল এজেন্সির দফতরে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমার কাগজপত্র সব ঠিক ছিল। সকলের আমায় নিয়ে কেন এত উত্তেজনা বুঝতে পারি না। যাঁরা সরাসরি যুক্ত তাঁদের কোনও দিন ডাক আসে না। তবে এটা ঠিক এই পরিস্থিতি আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে।
প্রশ্ন: কঠিন পরিস্থিতি পেরিয়ে যেতে পারলে সহজ জীবনের দেখা মেলে।
নুসরত: ঠিক বলেছেন। আমার ঘষামাজা হয়ে গিয়েছে। মনের জোর শতগুণ বেড়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
প্রশ্ন: ২০২৬ সালের নির্বাচনে ‘দিদি’ যদি আবার ডাকেন বা বিজেপি থেকে ডাক আসে...
নুসরত: তৃণমূল ডাকবে, না বিজেপি ডাকবে আমি জানি না। ডাক এলে কী করব সেটাও জানি না। আমার রাজনীতিতে আসার মূল কারণ ছিল দিদি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগত ভাবে খুবই শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি। উনি আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সবাইকে স্নেহ করেন। আমাদের আগলে রাখেন। দিদিকে কখনও ‘না’ বলতে পারব না। শেষ নির্বাচনের আগেও কথা হয়েছে দিদির সঙ্গে। ওঁর অজান্তে কিছু করিনি। সেটা আমায় সকলের সামনে বলতে হবে তার কোনও বাধ্যবাধকতাও নেই। কোনও সাক্ষাৎকারেও বলিনি।
প্রশ্ন: আপনি তো চুপই ছিলেন।
নুসরত: কী করব? যে কথাই বলি, তার ব্যাখ্যা হয় অন্য ভাবে। মানুষ অন্যের সমস্যা দেখলে মজা পায়। এখন আমি অনেক বদলে গিয়েছি। নুসরত মানেই বিতর্ক— এ ভাবে দেখা হত আমায়। আমি তার চেয়ে একটু বেশি। যাঁরা বিতর্ক বা সমালোচনা করছেন, তাঁরা আমার সমস্যার কথা জানেন না। আর যা বলা হয় তার বেশির ভাগই অর্ধসত্য।
প্রশ্ন: জীবনে এমন কোনও ঘটনা আছে যা আপনাকে ভেঙে দিয়েছিল?
নুসরত: একটা ঘটনা? বহু ঘটনা! যদি মানুষ সত্যি না জেনে সমালোচনা শুরু করে দেয় তা হলে কেমন লাগে! এমনও হয়েছে কোনও ঘটনার সঙ্গে আমি সত্যিই জড়িত নই। সেটার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলছে আমায়। অচেনা মানুষের দল আমার ছবির তলায় বাজে মন্তব্য লিখে দিয়ে যাচ্ছে! আমরা প্রকাশ্যে বলি, এগুলো কিছুই প্রভাব ফেলে না। কিন্তু আমিও তো রক্তমাংসের মানুষ। কষ্ট হয়। জানেন, আমি খুব আবেগপ্রবণ। একা বসে কত যে কেঁদেছি... সেখান থেকে আবার নিজেকেই বেরিয়ে আসতে হয়েছে। সব পেরিয়ে এখন আমি নতুন মানুষ। কাজ, সংসার আমার জগৎ। এখন নতুন গান এসেছে।
প্রশ্ন: ‘অর্ডার ছাড়া বর্ডার ক্রস...’।
নুসরত: এই কাজটা খুব উপভোগ করেছি। ২০১১ সালে আমার প্রথম ছবি ‘শত্রু’ মুক্তি পেয়েছিল। সে সময় থেকে দেখছি নায়িকাদের ‘আইটেম সং’ নিয়ে দর্শকের আলাদা উত্তেজনা থাকে। আর ‘যোদ্ধা’ ছবিতে প্রথম ‘আইটেম সং’-এ পা মিলিয়েছিলাম আমি। দর্শকের বিপুল ভালবাসা পেয়েছিলাম। নাচ করতে আমি খুব ভালবাসি। কোথাও একটা ভুল হয়, মানুষ ‘আইটেম গার্ল’ বলতে যেন বার ডান্সারের মতো কাউকে বোঝায়। এটা ঠিক নয়। নৃত্যশিল্পকে দেখা উচিত। আমার জন্মদিনে শিবুদা ফোন করে এই কাজের কথা বলেছিলেন। গানের কথাগুলো আমার খুব ভাল লেগেছে। জ়িনিয়া সেন নিজের লেখার মাধ্যমে ফুটিয়েছেন অনুপ্রবেশকারী এবং পুরো বিষয়টা। জ়িনিয়া, শিলাদা অসাধারণ গান তৈরি করেছেন। এই কথাগুলো এমন ভাবে সাজিয়েছেন তাঁরা, যা অনেক ভাবে ব্যবহার করা যায়।
নতুন গান নিয়ে উত্তেজিত নুসরত জাহান। নিজস্ব চিত্র।
প্রশ্ন: ‘রক্তবীজ ২’ ছবিতে অভিনয় করেছেন মিমি চক্রবর্তী। আপনার এই বিশেষ গান এবং মিমির বিকিনি লুক— দুই বন্ধু পরস্পরকে কি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল এই ছবিতে?
নুসরত: দু’জনেই আমরা একই ছবিতে কাজ করেছি। যে ছবির নায়িকা হলেন মিমি চক্রবর্তী। প্রথম ‘রক্তবীজ’-এ মিমি ছিল। মিমি খুব ভাল অভিনেত্রী। আমাদের মধ্যে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। হতে পারে, কারণে-অকারণে কথা হয় না। শুনুন, ভাল বন্ধুদের মধ্যে এই রেষারেষি থাকে না। বলা হয়, নায়িকারা বন্ধু হতে পারে না। মানুষে হতে দেয় কি? পরিস্থিতি সামলাতে দেয় কি? আমরা চেষ্টা করেছি, পারিনি। ব্যর্থ হয়েছি।
প্রশ্ন: অঙ্কুশ ‘রক্তবীজ ২’ ছবির অনেকটা অংশ জুড়ে। আপনার সঙ্গে অঙ্কুশের এক সময় প্রেম ছিল...
নুসরত: অঙ্কুশের সঙ্গে প্রেম ছিল না। অবশ্যই বন্ধু ছিলাম। একসঙ্গে অনেকগুলো ছবিতে কাজ করেছি তো।
প্রশ্ন: অনেকটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেই বন্ধুত্ব কি আবার তৈরি হবে?
নুসরত: এখন আর বন্ধুত্ব তৈরি করার পর্যায়ে নেই আমি। একটা সময় আমি, মিমি, অঙ্কুশ, যশ, শ্রাবন্তী, সায়ন্তিকা— একসঙ্গে এসভিএফে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতাম। সময়ের সঙ্গে আমরাও পরিণত হয়েছি। যে যার নিজের পথ বেছে নিয়েছি। কারও সঙ্গে ঝগড়া, মনোমালিন্য কিছু নেই। শুধুমাত্র সময় দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। সবাই আমরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।