প্রশ্ন: আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে এক মঞ্চে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়-দেব। একসঙ্গে অভিনয়ের মঞ্চও কি সেখান থেকেই প্রস্তুত?
রূপা: না না না। সেখানে বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। বিভিন্ন ক্ষেত্র, মতাদর্শ, রাজনৈতিকমনস্ক শিল্পীরা সে দিন প্রতিবাদ জানাতে জড়ো হয়েছিলাম। যেমন, ওখানে কিন্তু বাম দলের দেবদূত ঘোষও ছিলেন। আমার আর দেবের ছবিটা হয়তো সকলকে বেশি আকর্ষণ করেছে বা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। সেটা অন্য কথা! (বলে ফেলেই হাসি)। তবে দেবের সঙ্গে আমার এমনিও কথা আগে কখনও-সখনও হয়েছে। রাজনীতি নিয়ে কখনও কথা হয় না। ওর আগের কয়েকটি ছবি তৈরির সময়েও আমায় বলেছিল। আমিই উল্টে বলেছি, একে রাজনীতির সঙ্গে এমন ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। তার উপরে তুই আবার শাসকদলের সাংসদ। আমি দিনরাত বিরোধীপক্ষ হয়ে লড়াই-ঝগ়ড়া করছি! আবার তোর সঙ্গে ছবিও করব? আমিই বা কখন সময় দেব?
প্রশ্ন: শুনে দেব কী বলতেন?
রূপা: দেব তার পরেও ওর ছবিতে বড় চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ডেকেছিল। আমিই পারিনি। এ বার আর ‘না’ বলার সুযোগ দেয়নি। সটান বলল, ‘রঘু ডাকাত’ ছবিতে তোমায় ছোট্ট একটা পার্ট দিচ্ছি। শুটিংয়ে বেশি সময় লাগবে না। তোমার কাজ আটকাবে না। এটা করে দিতে হবে। না করলে কিন্তু কেলেঙ্কারি করে দেব। আর না করি কী করে? ছোট চরিত্রে অভিনয় বলে আমরাও খুব সমস্যা হয়নি। বড় জোর সাত-দশ দিন খরচ হয়েছে।
প্রশ্ন: সেটে দুই রাজনীতিবিদ মানেই রাজনৈতিক আদানপ্রদান?
রূপা: না, আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম, সেটে রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা বলব না। সেটে ভিন্ন মতাদর্শের অভিনেতারাও ছিলেন। সোহিনী সরকার যেমন। তিন মতাদর্শের তিন মাথা এক হলে রাজনীতি নিয়ে কথা মানেই তিল থেকে তাল হওয়ার সম্ভাবনা। তাই আমরা রাজনীতির ধারপাশে যেতাম না।
প্রশ্ন: দেব ডাকাত। আপনি ডাকাতের মা! কত বড় ডাকাতি করলেন?
রূপা: (জোরে হাসি) ডাকাতের মা কী বলছেন? ছবিতে আমি ‘ডাকাতরানি’ বা ডাকাত দলের প্রধান। (হাসি থামিয়ে) দেবের সঙ্গেই আমার যাবতীয় দৃশ্য। এর বেশি তো চরিত্র নিয়ে এখনই আর কিছু বলতে পারব না। তবে অভিনেতা দেব এবং মানুষ দেবকে খুব কাছে থেকে দেখলাম। খুবই মিষ্টি। খুব ভাল ব্যবহার। ফলে, খুব মজা করে কাজ করেছি। বুঝতেই পারছেন, অনেক বছর পরে আবার শুটিং করলাম...।
প্রশ্ন: কোনও সমস্যা?
রূপা: একেবারেই না। সারা ক্ষণ আমার খেয়াল রেখেছে। বরং এমনও হয়েছে, জলে ভিজে টানা শুটিং করার পর ওর আর শুট নেই। কিন্তু আমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যের শুটিং আছে। দেব বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার সেটে এসেছে। এসে বসে থেকেছে। আমার সমস্ত প্রয়োজন যাতে পূরণ করা হয়, তার জন্য। ওর সকলের সুখ-সুবিধার প্রতি খুব কড়া নজর। আমিও বাদ পড়িনি।
প্রশ্ন: স্টুডিয়ো এক সময় আপনার ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ ছিল। সেই ‘বাড়ি’তে ফিরে কেমন লাগল?
রূপা: খুবই ভাল লেগেছে। ক্যামেরার দায়িত্বে যিনি, সৌমিক হালদার তাঁর সঙ্গে ছোটবেলা থেকে চেনা। আমি ওর সঙ্গে অসংখ্য কাজ করেছি। ফলে, এই জায়গায় আমি স্বচ্ছন্দ। আমায় ক্যামেরা নিয়ে আর কিচ্ছু ভাবতে হবে না।
টলিউড নিয়ে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রশ্ন: দুই প্রজন্মের মধ্যে অনেক ফারাক?
রূপা: ফারাক কিছু দেখিনি। যাঁরা সব সময় কাজের মধ্যে থাকেন তাঁরা অভ্যস্ত। তাঁদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাও তাই বাকিদের তুলনায় অনেকটাই পোক্ত। আমিই বরং অনেক বছর পরে কাজ করতে গিয়েছি। তার জন্য প্রযোজনা সংস্থা সব রকম সহযোগিতা করেছে। আমি কিন্তু বলিনি, স্পটে আমার মেকআপ দেখার জন্য কাউকে দিতে হবে। ওরা নিজেরাই দিয়েছে। আমি বলে দিইনি, আমায় স্পটে সহযোগিতা করার জন্য সব সময় একজন দিতে হবে। ওরা কিন্তু নিজেরাই বিষয়টি বুঝেছে। আমার জন্য আলাদা ভ্যানিটি ভ্যান ছিল। ওরা জানত, আমি একা থাকতে পছন্দ করি। সবটাই হয়েছে কিন্তু দেবের জন্য। আর, সব শিল্পীদেরই কাজের পদ্ধতি আলাদা হয়। কেউ অনেক ক্ষণ পড়াশোনা করে করেন। কেউ চট করে চোখে জল আনতে পারেন। এত বছর কাজের দৌলতে এটা জানি। ফলে, কোনও সমস্যা হয়নি। বরং, এক গ্লাস জলের জন্যও আমায় অপেক্ষা করতে হয়নি। তবে, চরিত্রের জন্য প্রচুর সেজেছি...(হাসি)।
প্রশ্ন: কেমন সাজলেন?
রূপা: পর্দায় দেখে আমায় চিনতে পারবেন ন।
প্রশ্ন: মেকআপের পর আয়নায় নিজেকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন?
রূপা: আমাকে অন্য রকম দেখাচ্ছিল। বেশ মজা পেয়েছি। হ্যাঁ, নিজেকে চিনতে অসুবিধা হয়েছে। এটুকু বলতে পারি, আমাকে ওই সাজে কেউ কোনও দিন দেখেনি।
প্রশ্ন: মানে, ধুতির মতো করে শাড়ি পরানো?
রূপা: (মুখ টিপে হেসে) যতই চেষ্টা করুন, বলবই না!
প্রশ্ন: ‘ডাকাতরানি’ কি খুব অ্যাকশন করলেন?
রূপা: একটু একটু। আমাকে এই বয়সে যা মানায় ততটাই।
প্রশ্ন: হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের সময় ঘোড়ায় চড়েছিলেন...
রূপা: (মৃদু হেসে) সবেরই তো একটা বয়স আছে। ৩০ বছর বয়সে ঘোড়ার পিঠে চড়ে যা করেছি, ৬০ বছর বয়সে কি আর সেটা পারব? আমার যদি হাঁটুটা ভেঙে পড়ে যায়...! তা হলে তো গেলাম!
প্রশ্ন: ‘দ্রৌপদী’ রূপা সারা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। এত বছর পরে ‘ডাকাতরানি’ রূপা সেই জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনবেন?
রূপা: বিশ্বাস করুন, এত ভেবে ছবিটা করিনি। (একটু ভেবে), না অত কিছু হবে না। ছোট চরিত্র। সাড়া ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, যে ক’টি দৃশ্যে আছি সেগুলো দর্শক মনে রেখে দেবেন। ভুলতে পারবেন না, এটা বলতে পারি।
প্রশ্ন: এ বার থেকে আবার নিয়মিত অভিনয়?
রূপা: নিয়মিত হয়তো নয়। তবে মাঝেসাঝে কখনও হয়তো অভিনয় করব। আমার আজকাল আর মুম্বই গিয়ে অভিনয় করতে ইচ্ছা করে না। একা একা গিয়ে থাকা... বহু বছর করেছি সে সব। পেশার প্রয়োজনে। বয়স হয়েছে। এখন আর এ সব ভাল লাগে না।
রূপা গঙ্গোপাধ্যায় আবার বলিউডে যাবেন? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রশ্ন: ‘রঘু ডাকাত’-এ দেবের মা হলেন, আগামী ছবিতে কি জিতের মা?
রূপা: (হা-হা হাসি) জানি না তো! আমি কিচ্ছু জানি না। আসলে, আমার জীবনের প্রথম কয়েকটি ছবিতে বৃদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করেছি। যেমন, ধারাবাহিক ‘মুক্তবন্ধ’। আমার কাছে এগুলো আর ম্যাটার করে না। মানে, আমি কার মা, কার কাকিমা, কার প্রেমিকা— এ সব নিয়ে আর কিছু এসে যায় না। সব কিছু আমার কাছে চরিত্র। আর এই ছবিতে আমার কাছে চরিত্রটি ‘ডাকাতরানি’, ‘দেবের মা’ নয়।
প্রশ্ন: প্রতিবাদী মঞ্চ থেকে নেমে বলেছিলেন, আমায় নিয়ে কোন প্রযোজক ছবি বানানোর সাহস দেখাবেন? ছবি তো বন্ধ হয়ে যাবে... দেব সমস্যার প্রাচীর ভাঙলেন?
রূপা: অবশ্যই এটা দেবের সাহস।
প্রশ্ন: এই সাহস এ বার বাকিরাও দেখাবেন?
রূপা: আমি কী করে জানব! (একটু থেমে) আমি আর দোষারোপের খেলায় যেতে চাই না। ইন্ডাস্ট্রি এমন একটা জায়গা যেখানে প্রত্যেককে ভাবতে হবে, সবাইকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। তাতে যদি আমায় কোনও চরিত্রে মানায়, করব। এখন তো আর ঋতুপর্ণ ঘোষ নেই, যে ওই সাহসটা কেউ করবে! আমায় ‘অন্তরমহল’ ছবিতে একটি চরিত্র দিয়ে বলেছিল, ‘তোকে দেখতে ভাল লাগা যাবে না রুপসি। তোকে বুঝতে হবে, তুই বড়বৌ।’ আমি তার আগে বলেছিলাম, আমার গায়ের রং এত চাপা করে দিচ্ছ কেন? এ ভাবে আমরা কাজ করে বড় হয়েছি। আমার কাছে ইন্ডাস্ট্রিটা এখনও স্বপ্নের একটা জায়গা। যেখানে কোনও রাজনীতি থাকবে না।