ফাস্ট ফরোয়ার্ড মোডে চলছে জীবন। চাকরী, রিহার্সাল, মিটিং, ওয়র্কশপ, শো— মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। আনন্দ পালিত রোড, লেনিন সরণী, লিন্ডসে স্ট্রীট, রাসবিহারী অ্যাভিন্যু, কতগুলো রাস্তা যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল ক’বছরে। প্রিয় মানুষের মতো, সম্পর্কের মতো।
কাউকে ভালবাসি কিনা, দিন রাত তার সঙ্গে আষ্টে পৃষ্ঠে লেপ্টে থাকলে যেমন মনে থাকে না সব সময় তেমনই লেখাটা লিখতে বসে হারিয়ে যাওয়া সময় আর রাস্তা গুলোর জন্য মন কেমন করে উঠল।
কোথাও ছিল মামার বাড়ি, কোথাও কলেজ, কোথাও ছেড়ে আসা নাটকের দলের রিহার্সাল রুম, কিংবা প্রথম অফিস। প্রতিটা জায়গার আলাদা গন্ধ। শ্যাওলা বা বইপত্তর। ধুলো অথবা রং এর। আমার গন্ধের স্মৃতি তীব্র। মাঝে মাঝে মনে হয় চোখ বন্ধ করে শহর ঘোরালেও আমি বলে দিতে পারব কোথায় রয়েছি। বড়বাজারে না পার্কস্ট্রীটে, শ্যামবাজারে না টালিগঞ্জে। পরিচিত মানুষের শরীরের গন্ধের মতো চেনা প্রিয়-অপ্রিয় সব গন্ধ।
অনেক খানি রাস্তা বাসে করে যেতে হলে জানলার ধারে একটা সিট আমার চাই। মানুষজন, গাছপালা, দোকান পাট শুধু নয় আমি বাড়ি দেখি। নানা রকম, নানা দামের বাড়ি। উঁচু ফ্ল্যাট কী ছোট্ট ঝুপড়ি। মস্ত গেটওলা কী পুঁচকে একতলা, এজমালী কী বনেদি।
মজার কথা হল সব কটা বাড়িতেই আমার থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয় উঁকি মেরে দেখি ভেতরটা কেমন। কী রঙের দেওয়াল? ছাদ আছে? উঠোন না এক চিলতে বারান্দা? এত রকমের ঘরে এত রকম আলাদা আলাদা থাকার ব্যবস্থা। কী যে মজা! কোনও পাড়া জমজমাট হই হট্টোগোলে – কোনও রাস্তা নিরিবিলি। কোথাও মস্ত বারোয়ারী তো কোথাও একটা ছোট্ট মিস্টি দুগ্গা সরু গলি আলো করে রয়েছে।
বিদেশে গিয়ে দেখেছি বড় বড় শহরে থাকার জায়গা গুলো সব একরকম। লন্ডনে তো শুনেছিলাম শহরের মধ্যে একটু বেমানান একটা বড় কোনও বাড়ি ভাঙার জন্য জয়েন্ট পিটিশন করেছে নাগরিকেরা। ওদের সৌন্দর্য বোধের বহরে বেশ সমীহ বোধ হয়েছিল। কলকাতাতে সে সবের কোনও বালাই নেই। যার যে ভাবে ইচ্ছে থাক ভাই, কেউ নাক গলাতে আসবে না। নিজের সংস্কৃতি, ইতিহাস সম্পর্কে বাঙালীর ঔদাসীন্য ও পরকে আপন করে নেবার অপরীসীম দক্ষতা কলকাতাকে যাকে বলে একেবারে আর আমরা সকালে ইডলি-ধোসা, দুপুরে মাছ-ভাত, বিকেলে মোমো চাউমিন আর রাতে তড়কা-তন্দুরী খেয়ে বেশ গায়ে গতরে বাড়ছি।
ভাবলে অবাক লাগে ইটালিয়ান হোক বা লেবনিজ, থাই হোক বা জাপানিজ স্টার হোটেল থেকে বেরিয়ে ফুটপাথের স্টলে জাঁকিয়ে বসতে এ শহরে কতটুকুই বা সময় লাগে!
একই কথা বলা চলে ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও। পৃথিবী বিখ্যাত সব ব্রান্ড ঝাঁ চকচকে মলে আর তারই জারজ সংস্করণ দেদার বিকোচ্ছে নিউমার্কেট, গড়িয়াহাট, হাতিবাগানে। যার যেমন রেস্ত বেছে নাও। তোমারটা আসল আমারটা নকল! তাতে কী? ইউজ অ্যান্ড থ্রো এর জামানা ভাই। তুমিও দুদিন পরবে আমিও তাই।
গল্প শুনেছি আমরা অন্যমনস্ক, গানপাগল মা একবার ওস্তাদজীর বাড়ি থেকে একপায়ে হাইহিল ও অন্য পায়ে হাওয়াই চটি পরে দু-মাইল খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরে টের পেয়েছিল কান্ডটা। কলকাতায় চলতে ফিরতে সেই হাস্যকর বৈশাদৃশ্যই চোখে পড়ে সারাক্ষন। বা হয়তো পড়েও না।
আমিও আসলে খুঁড়িয়ে চলতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই সমঝোতাও করি, মিছিলেও হাঁটি। আড়াইশো টাকা দিয়ে মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখে ছ’টাকার ভিড় বাসে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হই। রাষ্ট্রের পেশী শক্তির বিরুদ্ধে জ্বলন্ত থিয়েটার করার জন্য রাষ্ট্রের কাছেই অনুদান প্রার্থী হই। ব্যবসার নামে নাক সিঁটকে নিজেরাই নিজেদের অশিক্ষিত পটুত্বে স্ফীত পিঠ চাপড়াই। নিজের বাড়ি পরিষ্কার রাখার জন্য রাস্তা নোংরা করি। যেন সেই নোংরা মাড়িয়ে কেউ কোনওদিন আমার ঘরে আসবে না।
এ শহরে মনোভাবটা হল—‘আমার অনেক আছে কিন্তু আমি দেখাব না’। অনুপম স্থাপত্য আছে যা আমরা কাদা মাখিয়ে রেখেছি। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে যা আমরা ভুলে থাকি। মায়াবী নদী আছে যাকে বিপদ জনক ভাবে নোংরা করে ফেলেছি। মনোরম উৎসব আছে যাকে কোলাহলে ভরিয়ে তুলেছি। আবেগ আছে যাকে দাক্ষিণ্যের প্রত্যাশী করে রেখেছি।
কিন্তু এত আক্ষেপের পরেও কলকাতা কী আমাকে ক্লান্ত করে? উত্তর এক কথায় ‘না’। ভাঙ্গাচোরা, ঘ্যান ঘ্যানে তিতিবিরক্ত শহরটা কখন যে ফুটপাতের বাচ্চাটার মতো মিষ্টি করে হেসে দেয় দেখে আমার মন ভাল হয়ে যায়।
প্রবল বৃষ্টিতে এক হাঁটু নোংরা জলের মধ্যে ভাসতে থাকা অকথ্য জঞ্জাল এড়াবার জন্য যখন এক ছাতার নীচে তার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি, তখন কর্পোরেশন কে গাল দেবার কথা মনেও থাকে না। নন্দন চত্তরে বা ভিক্টোরিয়ার ঝোপে ভাড়া করা নারী পুরুষের চুড়ান্ত অসভ্যতা দেখেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় – ‘আহা ওদের বোধ হয় প্রেম করার জায়গা নেই’। কলকাতার রাস্তায় ফুল প্রায় ফোটেই না, কিন্তু কোকিলগুলো বড্ড চেঁচায়।
গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি মাঝে মাঝে। ভাটার সময় যে নদী নোংরায় থই থই করে জোয়ারে সেই গরবিনী পূণ্যতোয়া। সব গ্লানি কেটে যায় আমার। দূরে দূরে জ্বলে ওঠা বিন্দু বিন্দু আলো মনে পড়িয়ে দেয় সুন্দর করে বাঁধানো টেমসের তীরের আভিজাত্য নিদেন পক্ষে হরকী পেয়ারী বা দশাশ্ব মেধের মাহাত্ম্য নয় আমার গঙ্গা বড় আটপৌরে তাই সে এত সুন্দর। ছোটবেলা থেকে রূপকথার মতো বাংলাদেশের বাড়ির গল্প শুনেছি। খুব রাগ হতো এক সময়। কেন যে এ দেশে এলাম? কী সুন্দর আম কুড়িয়ে, মাছ ধরে, হুটোপুটি করে আনন্দে বাঁচতাম। এখন মনকে বোঝাই তাহলে আমি কী আর আমি হতাম? মা এর সঙ্গে দেখা হত কি করে? স্যার এর সঙ্গে? নাটক করা হত কী এই শহরে না থাকলে? পৃথিবীর আর কোনও শহরেই বা এতগুলো মেধাবী মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে এমন পাগলামো করতে পারে? দিনের শেষে শ্রান্ত শরীরে হাওড়ায় বাবার কাছে ফিরি, বা টালিগঞ্জে আমার একলা ফ্ল্যাটে। পর দিন সকাল থেকে আবার বাস, মেট্রো, অটোয় ঝুলোঝুলি, গুঁতো গুঁতি। মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে কদিন বাইরে গিয়ে থাকি। অন্য কোনও শান্ত শহর বা নির্জন গ্রামে। কিন্তু কিছুতেই পিছুটান আলগা করে না এই শহর। কেবলই ভেঙে ভেঙে পড়ে, ডুবে যায়, পুড়ে যায় আর বেড়ে চলে বাজার হাট থেকে বারুইপুর, পৈলান থেকে খড়দহে। আর আমার মায়াভরা চোখে ভাসে মায়ের পায়ে সেই বেখাপ্পা জুতো জোড়া। তাই ডাস্টবিনের পাশে ফুটে ওঠে বেলফুলের চারা। টুনি বাল্ব আর উজ্জ্বল পোস্টারে ঢাকা শহরের মুখে যেন সস্তার গোল্ড ফেসিয়াল।
আসলে এই অগোছাল এলোমেলো, বলা ভাল সাংঘাতিকভাবে বিপরীত ভঙ্গীতে আয়েস করে বাঁচার ধরনটাই কলকাতার প্রাণশক্তি। তাই গোটা পৃথিবী ছুটে মরুক, মুখ থুবড়ে পড়ুক কলকাতা কিছুতেই লন্ডন হবে না। হতে পারে না কখনও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy