Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বহুরূপে সম্মুখে মিতিন

দেখে কে বলবে, এই আপন, আটপৌরে, আন্তরিক, পাশের বাড়ির মেয়েটিই ডাকসাইটে প্রাইভেট ডিটেকটিভ? বোঝার উপায় নেই, যে হাতে সে স্বামী, বোনঝিকে ব্রেন চপ বেড়ে এনে খেতে দেয়, সেই হাতের প্যাঁচই ছিটকে দিতে পারে খুনে গুন্ডাদের!

‘মিতিন মাসি’ সিনেমার দৃশ্য।

‘মিতিন মাসি’ সিনেমার দৃশ্য।

সুজিষ্ণু মাহাতো
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

‘‘তুমি কি পুলিশ?’’

মিষ্টি খুদের প্রশ্নের জবাবে আদর করে গোয়েন্দা প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায় বলে, ‘‘আমি মিতিন মাসি।’’

দেখে কে বলবে, এই আপন, আটপৌরে, আন্তরিক, পাশের বাড়ির মেয়েটিই ডাকসাইটে প্রাইভেট ডিটেকটিভ? বোঝার উপায় নেই, যে হাতে সে স্বামী, বোনঝিকে ব্রেন চপ বেড়ে এনে খেতে দেয়, সেই হাতের প্যাঁচই ছিটকে দিতে পারে খুনে গুন্ডাদের! সুচিত্রা ভট্টাচার্যের এই ‘মিতিন মাসি’কে পরিচালক অরিন্দম শীল নিজের মতো করে বদলে নিয়েছেন সিনেমার পর্দায়।

মিতিন মাসিকে জীবন্ত করে তুলেছেন কোয়েল মল্লিক। এই ‘অন্য’ কোয়েলই ছবির প্রাণ। তাঁর চোখেমুখে আদুরে সারল্য, স্নেহ রয়েছে। দুষ্কৃতীদের সামনে সেই প্রজ্ঞাপারমিতাই ইস্পাতকঠিন। তার স্বামী, পার্থর ভূমিকায় শুভ্রজিৎ দত্ত যথাযথ। যেমন তিনি থাকেন অরিন্দমেরই ছবিতে গোয়েন্দা শবরের সহকারী নন্দ হয়ে। পার্থর মুখের সংলাপ, ‘‘দেশে চৌকিদারের ছড়াছড়ি, গোয়েন্দার কাজ জুটলে হয়!’’— এর জন্য পরিচালকের তারিফ প্রাপ্য।

মিতিন মাসি
পরিচালনা: অরিন্দম শীল
অভিনয়: কোয়েল, বিনয়, রিয়া, শুভ্রজিৎ, জুন
৫.৫/১০

বাংলা ছবিতে গোয়েন্দার কমতি নেই। তবে সবাই পুরুষ। বছর পনেরো আগে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচয় করিয়েছিলেন মহিলা গোয়েন্দার সঙ্গে। আগাথা ক্রিস্টির ‘মিস মার্পল’ হয়ে উঠেছিল বাঙালি বাড়ির অন্দরমহলের রাঙাপিসি। ঋতুপর্ণ ছবি উৎসর্গ করেছিলেন বাংলার ঘরে ঘরে থাকা রাঙাপিসিদেরই। যাঁদের চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে হয়, কিন্তু সেখান থেকেই তাঁরা পড়ে ফেলেন চার দেওয়ালের বাইরের অনেক কিছু। ছবির শুরুতেই ঋতুপর্ণ লিখেছিলেন, ‘‘সেই সব মিস মার্পলদের উদ্দেশে যাঁরা চিরদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ে চোখ লাল করে ফিরলে সব বুঝেও চুপ করে থেকেছেন কেবল...’’

এই ক’বছরে দুনিয়া অনেক বদলেছে বাহ্যিক ভাবে। এখন পেশাদার গোয়েন্দা হন মহিলারাও। মিতিন মাসি গাড়ি ছোটায় শত্রুকে ধরতে। পিছনে বসে থাকে তার স্বামী। কিন্তু আদতে কতটা বদলেছে রাঙাপিসি-মিতিন মাসিদের দুনিয়া? এখনও মিতিন মাসিই খবর রাখে বাড়িতে কাজ করতে আসা মহিলার সংসারের সমস্যার। এখনও তাকে শুনতে হয়, ‘মেয়েছেলে গোয়েন্দা!’

পর্দার মিতিন মাসি এমন সুনির্মিত হলেও খামতি থেকে গিয়েছে অপরাধীর চরিত্র নির্মাণে। কেন সে অপরাধে প্রবৃত্ত হল, তার দুনিয়া, তার ভাবনার ছবি, কোনও বিশদ ব্যাখ্যা উঠে আসে না। সেখানে কিছুটা হলেও ছবিটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। অরিন্দমের ‘এবার শবর’-এ পান্তু হালদারকে মনে থেকে গিয়েছিল। তেমন কেউ এখানে নেই। মূল গল্পের আশপাশে একাধিক অণুগল্প থাকলে কাহিনি আরও পূর্ণতা পেত। প্রথম বাংলা ছবিতে জাত অভিনেতা বিনয় পাঠক চিত্রনাট্য অনুযায়ী যতটা সুযোগ পেয়েছেন, নজর কেড়েছেন। তবে এমন একজন অভিনেতাকে পেয়ে আরও একটু ব্যবহার করতে পারতেন পরিচালক। মিতিনের সহকারী টুপুরেরও (রিয়া বণিক) বিশেষ কিছু করার থাকে না। মিতিন মাসির উপরে নজর দিতে গিয়ে চিত্রনাট্যে বাকি সকলে যেন হারিয়ে গিয়েছে।

যুক্তিহীন কিছু দৃশ্যও। একাধিক পুলিশকর্তা, মিতিনের স্বামী, টুপুর ঘটনাস্থলে থাকলেও কেন মিতিন মাসি একাই গুন্ডাদের সঙ্গে লড়ে যায়, তাদের একা ধরাশায়ী করে দেয় তা বোধগম্য হয় না। অবিশ্বাস্য এটাও যে, ২০১৯-এর কোনও অপহরণের গল্পে অপরাধী বা গোয়েন্দা কারও কাছেই কোনও আগ্নেয়াস্ত্র নেই! অরিন্দমের শবর সিরিজ়ে যে টানটান ভাব আমরা পাই, এখানে সম্পাদনায় তার একটু খামতি রয়েছে। জোরালো হতে পারত ক্লাইম্যাক্সও। তবে আলাদা করে বলতেই হবে বিক্রম ঘোষের আবহসঙ্গীতের কথা।

হালের বাংলা গোয়েন্দা ছবির বেশির ভাগের বিষয়ই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। সেখানে পর্দায় মিতিন মাসির আবির্ভাব ছোটদের চাহিদা পূরণ করতে পারে। ছবিতে অবশ্য বড়দের ভাবনার খোরাক রেখেছেন অরিন্দম। পর্দার মিতিন মাসি নিজে মা নন। কিন্তু মাতৃত্বের উদ্‌যাপন কি সন্তানধারণ ছাড়া হতে পারে না? জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন পরিচালক। সব মিলিয়ে পর্দায় পুরুষ গোয়েন্দাদের দখলদারিকে প্রশ্ন তুলতে হাজির হয়ে গিয়েছে মিতিন মাসি, দেবীপক্ষেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE