ছবি: কৌশিক সরকার।
সেটাও ছিল এপ্রিল। আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে। সাল ২০০৪।
তারিখটা ১ এপ্রিল। তখন সকাল ১১টা হবে। ডা. রবীন ঘোষের ক্লিনিকে আমি, পাশে ডা. রাজীব শীল যিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। রিপোর্ট দেখে ডা. ঘোষ আস্তে আস্তে বললেন আমার ক্রনিক মাইলয়েড লিউকোমিয়া হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে সব কী রকম তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল, বুঝতেই পারছিলাম না কী বলব। মনে আছে ওখানে বসেই একবার মনে হয়েছিল ভগবান কি তা হলে আমার সঙ্গে এপ্রিল ফুল করছেন। পরমুহূর্তে মনে হয়েছিল, “ভরত, এ বার প্যাক আপ হল বলে। এ বার যাওয়ার পালা।”
আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম ক্লিনিক থেকে। বিবেকানন্দ পার্ক থেকে আনোয়ার শাহ রোড অবধি নিজের জীবনের ফ্ল্যাশ ব্যাক দেখতে দেখতে হাঁটতে শুরু করলাম। কখনও জোরে জোরে হাঁটছি। কখনও আস্তে। সেই মুহূর্তে বুঝতে পারছিলাম না কিছুই। কিন্তু আজ দশ বছর পর মনে হয় ওই হাঁটাটাই আমার জীবন যেন পাল্টে দিয়েছিল। শপথ নিয়েছিলাম লিউকোমিয়ার কাছে হারব না।
আজ দু’ হাজার চোদ্দোতেও পথ চলছি। কখনও একা একা, বেশির ভাগ সময়ই দুর্দান্ত কিছু বন্ধুদের সঙ্গে।
লাইফ হ্যাজ কাম আ ফুল সার্কেল
আজকে ২০১৪তে এই প্রথম কোনও সংবাদমাধ্যমের কাছে কথাগুলো বলছি। এই দশ বছর হয়তো আমার কিছু অস্বস্তি ছিল। সবার সামনে আমার নিজের জীবনের এই দিকটা তুলে ধরতে চাইনি।
এই দশ বছরে আমার জীবনটাই যে পাল্টে গিয়েছে। লিউকোমিয়া ধরা পড়ার পর আমি মুম্বইতে থাকা শুরু করি। ওখানে টেলিভিশনের কাজ করতাম। পাগলের মতো ভালবাসতে শুরু করি সায়ন্তনী বলে একটি মেয়েকে। তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলেও সে আমার ভাল বন্ধু, আমার সব সময়ের ওয়েল উইশার। আবার কলকাতায় ফিরে এলাম গত বছরে।
ফিরে এসে সন্দীপ রায়ের সঙ্গে ফেলুদা করলাম। ‘অরুন্ধতী’তে কোয়েলের সঙ্গে কাজ করলাম, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘খাদ’য়ে অভিনয় করলাম। প্রায় এক যুগ পরে ‘রাজযোটক’ বলে একটা সিরিয়ালে অভিনয় করছি এই মুহূর্তে।
আজ এ সবের মাঝে হঠাত্ করে একটা তাগিদ অনুভব করছি আমার পুরনো দিনের কিছু কথা বলার।
লাইফ ফর মি, হ্যাজ কাম আ ফুল সার্কেল।
আমি তো চুরি করিনি। কিন্তু বাবা-মা কী বলবে
ওই রকম একটা খবর পাওয়ার পর প্রথম মনে হয়েছিল এই খবরটা আমি মা বাবাকে কী করে বলব!
আমি তো চুরি করিনি, আমি তো কাউকে মারিনি, আমি তো লজ্জাজনক কিছু করিনি। তা হলে মা-বাবার কাছে বলতে লজ্জা কীসের? কিন্তু এটা বোঝানো যায় না। আমার লিউকোমিয়া হয়েছে এটা কি কখনও মা-বাবাকে বলা যায়?
সে দিন বুঝিনি কিন্তু আজকে বুঝি এমনটা যার জীবনে ঘটেছে কেবল সেই বুঝতে পারবে। হ্যাঁ, যুবরাজ সিংহ বুঝবে। মনীষা কৈরালা বুঝবে। কারণ তারাও এই খবরটা কোনও না কোনও সময়ে পেয়েছে এবং বাড়ির লোকের সঙ্গে শেয়ার করেছে।
সে দিন হাঁটতে হাঁটতে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের গাছগুলো দেখছিলাম। ফ্ল্যাটগুলো দেখছিলাম। দেখতে দেখতে ভাবছিলাম এই পৃথিবীটা এত ভালো, কিছুতেই আমি এই জায়গাটা এত সহজে ছেড়ে চলে যাব না।
এই ভাবতে ভাবতে ফিরলাম স্টুডিয়োতে। তার ঠিক কিছুদিন বাদেই আমার বঙ্গ সম্মেলনে যাওয়ার কথা আমার। সেই নাটকের রিহার্সাল চলছিল আমারই স্টুডিয়োতে। শঙ্কর (চক্রবর্তী) ছিল, বিশ্বজিত্দা (চক্রবর্তী) ছিল। এসে ওদের খবরটা দিলাম। ধীরে ধীরে বাবাকে বললাম। আজকে বুঝি বাবা অত স্ট্রং ছিলেন বলেই ফাইট করতে পেরেছিলাম। বাবা পুরোটা শুনে বলেছিলেন, “ঠিক আছে দ্য ওয়ার্স্ট ইজ ওভার। এ বার আমরা লড়ব।”
ওরা ভাবছে শেষ বারের মতো ভরতকে দেখছি
১ এপ্রিল এই খবরটা পাওয়ার পর ৪ এপ্রিল কিন্তু আমি আমার টিমের সঙ্গে লন্ডন চলে গেলাম। লন্ডনের ফ্লাইটেও খালি লিউকোমিয়ার কথাই মাথায় ঘুরছিল। ওখানে আমার দিদি থাকেন। শোয়ের পর দিদির বাড়িতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যে দিন আমার দলের বাকিদের ফেরার কথা সে দিন এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম তাদের সঙ্গে দেখা করতে। মনে আছে সবার চোখ আমাকেই খুঁজছিল। সে দিনও বুঝেছিলাম, আজও বুঝি ওদের চোখের ভাষা কী বলতে চাইছিল। ওরা ভাবছিল হয়তো এই শেষবারের মতো ভরতকে দেখছি। একে একে চান্দ্রেয়ী, অলকাদি, বিশ্বজিত্দাও আমাকে জড়িয়ে খানিকক্ষণ কাঁদল।
ওদেরকে ‘বাই’ বলতে বলতেই ভাবছিলাম এই কান্নার জবাব আমাকে দিতেই হবে। যে মানুষগুলো আমাকে এত ভালবাসে, তাদের ভালবাসার জোরেই আমি ঠিক হয়ে যাব।
“মৃত্যুকে সামনে দেখেও বুঝেছি, যদি ভাল বন্ধু আর ফ্যামিলি থাকে
তা হলে মৃত্যুর মুখ থেকেও তারা আপনাকে ছিনিয়ে আনতে পারে”
প্রথমে ভয়, তার ওপর আমি কেন, শেষমেশ আশা
আজ এত বছর পরে যখন সব কথাই বলছি তখন আমার মনে হয় নিশ্চয়ই এই লেখাটা এমন কিছু মানুষ পড়ছে যারা আমার স্টোরি থেকে অনুপ্রাণিত হতে পারে।
তাদের উদ্দেশে বলি, এই রোগ জানার পর তিনটে স্টেজ আসবেই।
প্রথমটা ভয়। এ যে কী ভয় আমি বলে বোঝাতে পারব না। রাতে কাঁদতাম। প্রায় হাপুস নয়নে কাঁদতাম। সর্বক্ষণ মনে হত আর ক’দিন বাঁচব? যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে, খালি মনে হচ্ছে পরের বার আবার দেখা হবে তো এই মানুষটার সঙ্গে?
এটা যদি প্রথম পর্ব হয়, তা হলে দ্বিতীয় পর্ব হয়তো সেল্ফ-পিটি। নিজের ওপরই যেন কী রকম একটা করুণা ভাব আসবে। মন বলবে, এটা কি আমার কর্মফল? ভগবান, হোয়াই মি? ভগবান, কেন তুমি আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছ?
আর তৃতীয় ফেজ হচ্ছে নিজের মন থেকে সব খারাপ চিন্তা দূর করে দেওয়া। এই থার্ড ফেজটা যে দিন থেকে শুরু হবে, সে দিন থেকে দেখবেন রোগটাকেও আপনি কাবু করতে পারছেন। এই তৃতীয় ফেজটায় আপনাকে সাহায্য করতে পারে আপনার কিছু বন্ধু এবং আপনার পরিবার। আজকে মৃত্যুকে সামনে দেখেও বুঝেছি, যদি ভাল বন্ধু আর ফ্যামিলি থাকে সঙ্গে তা হলে তারা মৃত্যুর মুখ থেকেও আপনাকে ছিনিয়ে আনতে পারে।
লাইফ ইজ বিউটিফুল
কিন্তু এর মাঝেও কিছু প্র্যাকটিক্যাল সমস্যা আছে। লন্ডনে যখন থাকতে শুরু করলাম ওখানেই প্রথম ম্যাক্স ফাউন্ডেশন নামক এক সংস্থার নাম শুনি। সারা পৃথিবীতে ওরা লিউকোমিয়া আক্রান্ত মানুষদের কম টাকায় ওষুধ দেন। আজকে এত দিন পরে আমার লিউকোমিয়া অ্যারেস্টেড হয়েছে, কিন্তু তাও আমাকে প্রত্যেক দিন ওষুধ খেতেই হয়। প্রায় ছ’শো মিলিগ্রাম ওষুধ খাই আজও। এমনিতেই সেই ওষুধের খরচ প্রায় ছ’হাজার টাকা কিন্তু ফাউন্ডেশনের দৌলতে অনেক কম টাকায় সেটা পাই।
এর মাঝখানে একজন মানুষের নাম না করলে আমার অন্যায় হবে। তার নাম সায়ন্তনী। আমার লিউকোমিয়া ধরা পড়ার আগে থেকেই ওর সঙ্গে আমার আলাপ। লিউকোমিয়ার পর যখন আমি মুম্বই ফিরে যাই, সায়ন্তনীও ওখানে আমার সঙ্গে থেকে যাওয়ার ডিসিশন নেয়। আমার ওষুধ দেওয়া থেকে সব কিছুর খেয়াল রাখত ও। আজকে আমরা সম্পর্কে আবদ্ধ নই। কিন্তু ও আমার অসম্ভব শুভাকাঙ্ক্ষী। জানি কোনও দরকার হলে ওকে আমি ফোন করতে পারব। ওর মা বাবার সঙ্গেও আমার কথাবার্তা হয়।
এক সময়ে আমার স্ত্রী ছিল অনুশ্রী (দাস)। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, ওরকম রোগ জানার পর কখনও কি মনে হয়নি, অনুশ্রীকে ফোন করার কথা? ডিভোর্স হয়েছে ঠিকই কিন্তু এক সময় তো বৌ ছিল।
তাদের আমি একটা কথায় উত্তর দিয়েছি। ওই রকম রোগ জানার পর না, মানুষ সবার আগে এটা বোঝে যে, এই পৃথিবীতে সে একা। সবাই পাশে থাকতে পারে, কিন্তু এই লড়াই যে গুরু তোমাকে নিজেকেই লড়তে হবে। তাই অনুশ্রীকে আর ফোনটা করা হয়ে ওঠেনি।
আর বন্ধুদের কথা যদি বলি, তা হলে প্রথমেই বলতে হয়, কোয়েল ও নিসপাল সিংহ-এর কথা। ওরা আমার জন্য যা করেছে আমি ভুলতে পারব না। নিসপালকে তো আমি বলি, ওর নিশ্চয়ই আগের জন্মে আমার কাছে অনেক ধার ছিল। এই জন্মে তাই ও সেই ঋণ চোকাচ্ছে। এ ছাড়া মণি রয়েছে, শ্রীকান্ত রয়েছে, যারা সর্বক্ষণ আমার পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছে, সম্মান জানিয়েছে, কাজ দিয়েছে। জীবনের প্রতি আমার আসক্তি বাড়িয়েছে ওরা। জীবনটা সত্যি সুন্দর।
ওপরে আরও বড় প্ল্যানার বসে আছেন
তবে জানেন, ওই ঘটনার পর আজকে অনেক কিছু দেখে আমার হাসি পায়।
আজকে শ্যুটিংয়ের অবসরে অনেকের ফিউচার প্ল্যান শুনি। কেউ বলছে এত টাকা যদি ফিক্স করি তা হলে পাঁচ বছর পরে এত পাব। কেউ বলে কুড়ি লাখ টাকার ইএমআই মিটে গেলে বাড়িটা আমার। কেউ বলে আজকে জমিটা কিনে নিই, পাঁচ বছর পর দাম দ্বিগুণ হবে।
এদের কথা আমি শুনি আর হাসি। কাউকে ছোট করতে চাই না, কিন্তু এই রকম কথাবার্তা শুনলে মনে হয় এই সব প্ল্যান কতটা ভঙ্গুর। এক সকালে এই সব প্ল্যান যে চোখের সামনে ভেস্তে যেতে পারে সেটা আমি দেখেছি।
এটাও বুঝেছি তুমি যত বড়ই প্ল্যানার হও না কেন, ওপরে তোমার থেকে বড় এক জন প্ল্যানার বসে আছে। চাই সবাই যেন আনন্দে থাকে।
চাই না, কারও জীবনে যেন ওই অভিশপ্ত পয়লা এপ্রিলটা আসুক...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy