Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
বছরের বিস্ময়

পিঙ্কই বছরের সেরা হিন্দি ছবি, অমিতাভ সেরা বিস্ময়

অমিতাভ আগাগোড়া বটগাছ নন। দর্শককে আমোদিত করার চেষ্টাও নেই। জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়-এর তবু মনে হল বছরের সেরা হিন্দি ছবিগোলাপি রংটা বড় তুলতুলে, তাই না? কেমন আইসক্রিমের মতো, যেন এখুনি গলে যাবে। মেয়েদের জামায় ওই রং থাকে। রুমালে, নখপালিশে থাকে। ঠোঁটেও মেয়েরা ওই রংটা ঘষে। আহা রে গোলাপি, আহা রে মেয়ে!

ছবির একটি দৃশ্যে। —ফাইল চিত্র।

ছবির একটি দৃশ্যে। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:২৮
Share: Save:

গোলাপি রংটা বড় তুলতুলে, তাই না? কেমন আইসক্রিমের মতো, যেন এখুনি গলে যাবে। মেয়েদের জামায় ওই রং থাকে। রুমালে, নখপালিশে থাকে। ঠোঁটেও মেয়েরা ওই রংটা ঘষে। আহা রে গোলাপি, আহা রে মেয়ে!

***

কাপড় শুকোনোর দড়িতে একটা অন্তর্বাস ঝুলছে। হাঁ করে দেখতে দেখতে পাশের বাড়ির পুরুষটি কল্পনার দুনিয়ায় হারিয়ে গেলেন। প্রথমে অন্তর্বাসের মালকিনের কথা ভাবলেন। তার পর রাস্তা দিয়ে যত মহিলা হেঁটে গেলেন, পুরুষটি মনশ্চক্ষে দেখতে পেলেন এগিয়ে যাচ্ছে সারি সারি অন্তর্বাস! সারি সারি গোলাপি। সামনের বারান্দায় মধ্যবয়সিনি মনে মনে গাল পাড়েন! শুকোতেই যদি দিবি, ঢেকেঢুকে দিবি তো!

***

নীতি পুলিশের দফতরে থাক-থাক জমা হচ্ছে মেয়েদের গোলাপি চাড্ডি। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসেছে। ওরা নিজেরাই বলছে, ওরা নাকি ফালতু টাইপের মেয়ে। চরিত্তিরের ঠিক নেই, এখানে সেখানে যায়। অখাদ্যকুখাদ্যপানীয় খায়। যাদের তা নিয়ে আপত্তি আছে, তাদের ওরা চাড্ডি উপহার পাঠাচ্ছে। আর এক দলের কথা শোনা যাচ্ছে, তারা আবার লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। বলছে, মদ খেয়ে বউ পেটানো আর চলবে না। যে বউয়ের গায়ে হাত তুলবে, গুলাবি গ্যাং এসে তার হাত ভাঙবে।

এতক্ষণ ধরে যা যা লিখলাম, তার সঙ্গে ‘পিঙ্ক’ ছবিটার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই বললেই চলে। ছবির গল্পে কোথাও এ সব কথা নেই। গোলাপি অন্তর্বাসের এক চিলতে দৃশ্যটি ছাড়া দাগিয়ে দিয়ে গোলাপি রংটাও নেই। এখনও অবধি এ বছরের সেরা হিন্দি ছবির নামটা শুধু অজস্র অনুষঙ্গকে মনে করিয়ে দিচ্ছে মাত্র।

সে অনুষঙ্গ হতে পারে নির্ভয়া, হতে পারে পার্ক স্ট্রিট, হতে পারে উবের...। হতে পারে ছবিকে ছাপিয়ে, ছাড়িয়ে যাওয়া সব অনুরণন। খবরের কাগজে না ওঠা, পুলিশের খাতায় না থাকা, আদালতে না আসা লাখো লাখো বিক্ষত দেহমন। আমরা মেয়েরা প্রত্যেকে কোনও না কোনও মাত্রায় গোপনে-অগোপনে বহন করে চলি থেঁতলে যাওয়ার চিহ্ন। ছাল ওঠা চামড়ার রং-ও গোলাপিই বটে। আর সেই দগদগে ঘায়ে আমাদের সমাজ, আমাদের সিস্টেম, এমনকী আমাদের কাছের মানুষরাও সযত্নে নুন, লঙ্কা, মরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয়। ‘পিঙ্ক’ এক নিঃশ্বাসে এই গল্পটাই বলে।

এক নিঃশ্বাসেই, কারণ ‘পিঙ্ক’ দেখলে মনে হয়, নির্মাতা এবং কলাকুশলীরা সবাই একটা পাখির চোখ দেখছিলেন। ছবির থিমটাই সেই চোখ। এক মিনিটের জন্যও অন্য কোনও দিকে দৃষ্টি ফেরাননি, দর্শককেও ফেরাতে দেননি। কোনও অতিরিক্ত সাবপ্লট, থ্রিল বাড়ানোর মালমশলা, সেন্টিমেন্টের বন্যা, খুচরো অ্যাকশন-চেজ কিচ্ছুটি আমদানি করার প্রয়োজন মনে করেননি। কারণ দর্শককে আমোদিত করার চেয়ে ভাবিয়ে তোলাই তাঁদের লক্ষ্য ছিল। বাণিজ্যিক ধারায় এতটা নির্লোভ ছবি, ক’টা দেখেছি মনে করতে পারছি না।

ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের মতো তারকা আছেন। কিন্তু টাইটল কার্ডে তাঁর নামটা প্রথম নয়। অমিতাভ আছেন বলেই বাকি চরিত্রদের ঢেকে দিয়ে তাঁকে সর্বক্ষণ ফোকাস করা হচ্ছে, তাও নয়। প্রথমার্ধে অমিতাভ খুব বেশি কিছু করছেনই না। আবার সেই কারণে তাঁকে স্বমহিমায় এন্ট্রি দেওয়ানোর জন্য আলাদা করে কোনও দৃশ্য জমিয়ে রাখাও হচ্ছে না। অমিতাভ এসে দাঁড়ালেন আর ‘দেখতে রহিয়ে’ বলে ইন্টারভাল হয়ে গেল — নাঃ এমনটাও ঘটছে না।

ছবিতে বারবারই শুনবেন ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল এক রক কনসার্টে গিয়ে। সেই কনসার্টটার এক ঝলকও ছবিতে নেই। একটা কানফাটানো গান আর তিনটি মেয়ের কোমর দোলানোর একটা দৃশ্য আরামসে থাকতে পারত। সে গুড়ে এক গামলা বালি। তার পর রিসর্টে গিয়ে কী হল, ‘গল্পের দাবি মেনে’ তার একটা রগরগে বিবরণ... কোথায় কী? একেবারে এন্ড টাইটলে কিছু ক্লিপিং ছাড়া গোটা ছবিতে আপনি জানতেও পারবেন না, ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছিল। জানতে পারবেন না, কারণ জানার প্রয়োজন নেই। ‘একদিন প্রতিদিন’ যেমন জানতে দেয়নি, মেয়েটি সে রাতে কোথায় ছিল! ঘটনা নয়, ঘটনার অভিঘাতটাই এখানে গল্প। তাই ‘পিঙ্ক’ দেখলে কেবলই মনে হবে, মিনাল অরোরা তো না হয় বোতল দিয়ে ছেলেটাকে মেরেছিল! কিন্তু যদি না মারত? যদি মেয়েগুলো সে দিন ধর্ষিত হতো? তা হলেও কিন্তু প্রশ্নগুলো একই থাকত! কেন ছেলেদের সঙ্গে গিয়েছিলে? কেন রাতে বেরিয়েছিলে? কেন মদ খেয়েছিলে? কেন নন-ভেজ জোকের উত্তরে নন-ভেজ জোকই বলেছিলে? কেন ঠাট্টা করে ছেলেটির কাঁধে আলতো চাপড় মেরেছিলে?... মেয়েদের সঙ্গে অন্যায় হওয়াটা বড় কথা নয়। নির্বুদ্ধিতা বা অতি চালাকির বশে মেয়েটি কী ভাবে ওই অন্যায়কে ডেকে এনেছে, সেটাই যেন আসল।

‘আদালত ও একটি মেয়ে’, ‘দামিনী’, ‘দহন’, ‘দ্য অ্যাকিউজড’-এর মতো ছবি, ‘চোপ আদালত চলছে’-র মতো নাটকে এই সঙ্কটের কথা আগেও এসেছে। এর পরেও ‘পিঙ্ক’ আলাদা করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ সে তার নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে, নিজের সময়ের চিহ্ন শরীরে খোদাই করে কথা বলছে। মিনাল, ফলক, আন্দ্রেয়ারা আজকের মেয়ে। তাদের যাপনটা আজকের মতো। তাপসী পান্নু আর কীর্তি কুলহারি অভিনয় করেছেন অতুলনীয়। ক্রোধে, অপমানে, হতাশায়, যন্ত্রণায় গোটা ছবি জুড়ে একটা দমবন্ধ আবহাওয়া তাঁরা একেবারে আত্মস্থ করে রেখেছেন। তাপসী বা কীর্তি, কেউই হিন্দি ছবিতে খুব বেশি পুরনো নন। ফলে তাঁদের ঘিরে এখনও যেহেতু দর্শকের মনে খুব বেশি পলি জমেনি, দু’জনকেই খুব সহজে পাশের বাড়ির মেয়ে বলে মনেও হচ্ছে। ‘নর্থ ইস্ট’-এর আন্দ্রেয়া তারিয়াং-ও খুবই বিশ্বাসযোগ্য। তবে তিনি আর অমিতাভের স্ত্রীর চরিত্রে মমতা শঙ্কর আরেকটু বিকশিত হওয়ার জায়গা পেলে আরও ভাল হতো।

অমিতাভ বচ্চন বটবৃক্ষের মতো মাথা তুলবেন, সে তো নতুন কথা নয়। যদিও আগেই বলেছি, এ ছবিতে অমিতাভ আগাগোড়া বটগাছ নন। বরং ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি একটু একটু করে জেগে ওঠার মতো করে অসুস্থ বৃদ্ধ দীপক সেহগল ক্রমে ক্রমে নিজেকে মেলে ধরেন। বিখ্যাত ব্যারিটোন ধাপে ধাপে তার সপ্তক খুঁজে নেয়। বিপক্ষের উকিল পীযূষ মিশ্র বা বিচারক ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্র দু’টি খানিক ছাঁচে ফেলা বলে মনে হতে পারে। মনে হতে পারে, অভিযুক্তদের মতোই তাঁদেরও কাজ হচ্ছে অমিতাভকে তাঁর সংলাপগুলো বলার সুযোগ করে দেওয়া। আর একটু কম সাদা-কালো হতে পারত দ্বিতীয়ার্ধটা। আবার এটাও ঠিক, আমাদের দেশের যা অবস্থা তাতে অনেক কথাই এখনও চোঙ্গা ফুঁকে, হাতুড়ি পিটিয়ে না বললে শোনানো যায় না।

ভাবতে ভাল লাগছে, মূল অভিনেতা আর চিত্রনাট্যকার (রীতেশ শাহ) ছাড়া এ ছবির কলাকুশলীদের বেশির ভাগই বাঙালি। এবং তাঁরা সকলেই ছবিটির সুনির্মাণে নিজেদের ছাপ রেখে গেছেন।

আবহসঙ্গীতে ফৈজা মুজাহিদ ছাড়া বাকি দুজন শান্তনু মৈত্র, অনুপম রায়। ক্যামেরায় অভীক মুখোপাধ্যায়, সম্পাদনায় বোধাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, কালারিস্ট দেবজ্যোতি ঘোষ। পরিচালনা অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী আর সৃজনশীল প্রযোজনা সুজিত সরকার। হিন্দি ছবিতে অনিরুদ্ধের এর থেকে ভাল শুরু আর হতে পারে না। আর সুজিত তো যাতেই হাত দিয়েছেন তাতেই সোনা। ‘পিকু’ থেকে ‘পিঙ্ক’ — প-এ পয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pink film tollywood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE