Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

পোস্টার ড্রামা

কর্ণ জোহর থেকে শাহরুখ খান। তাঁদের বাড়ি, পার্টি সেজে উঠছে হাতে আঁকা পোস্টারে। লিখছেন নাসরিন খান।সিনেমার পোস্টার বললেই ঢাউস, বড়সড়, রংচঙে পোস্টারগুলোর কথা মনে আসে, তাই না? কিন্তু সেগুলোর মধ্যেও সুন্দর একটা শিল্পসত্তা উঁকিঝুঁকি মারত। কারণ একটাই। সেই পোস্টারগুলো বেশ যত্ন করে হাতে আঁকা হত। এখনকার ডিজিটাল পোস্টারগুলোতে কিন্তু সেই গুণ নেই।

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৫ ০০:৩৬
Share: Save:

সিনেমার পোস্টার বললেই ঢাউস, বড়সড়, রংচঙে পোস্টারগুলোর কথা মনে আসে, তাই না? কিন্তু সেগুলোর মধ্যেও সুন্দর একটা শিল্পসত্তা উঁকিঝুঁকি মারত। কারণ একটাই। সেই পোস্টারগুলো বেশ যত্ন করে হাতে আঁকা হত। এখনকার ডিজিটাল পোস্টারগুলোতে কিন্তু সেই গুণ নেই।

একতা ভট্টাচার্য এ শহরের এক শিল্পী। হাতে আঁকা পোস্টারের সেই ওল্ড চার্ম-টা তিনি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন আরও একবার। বহু দিন পর এমনই এক পোস্টার চোখে পড়ল হিন্দি ছবির জগতেও। আগে ছবির প্রচার বা বিজ্ঞাপন হাতে আঁকা পোস্টার ছাড়া ভাবাই যেত না। শুধু পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নয়, ‘হমারি অধুরি কহানি’র গল্প নিয়ে তৈরি নাটকের জন্য একতার হাতে আঁকা এই পোস্টারের প্রশংসা করেছেন স্বয়ং মহেশ ভট্ট এবং পূজা ভট্ট।

চওড়া ব্রাশ দিয়ে রং করা চোখধাঁধানো এই পোস্টারগুলোয় থাকত থ্রিডি স্টাইলের টাইপোগ্র্যাফি। সেই টাইপোগ্র্যাফি যা কিনা এখন শিল্পরসিকদের সংগ্রহেই একমাত্র পাওয়া যায়। কম্পিউটার আসার পর হাতে আঁকা পোস্টারের কোনও অস্তিত্বই আর নেই বলা যায়। যদিও ভিন্টেজ শিল্প যাঁদের খুব প্রিয় তাঁরা ছবির পোস্টারের এই টাইপোগ্র্যাফি বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন কেতাদুরস্ত পোশাকে, ঘর সাজানোর জিনিসপত্রে। যদিও পরে ডিজিটাল ইমেজ হাতে আঁকা পোস্টারকে মেরেই ফেলে।

সেই সব পোস্টার শিল্পীরা বেশির ভাগই স্বশিক্ষিত ছিলেন। হাতে আঁকা পোস্টার বেচে তাঁদের জীবন চালানো ছিল মস্ত সমস্যা। সাঙ্ঘাতিক প্রতিভাবান হলেও এই শিল্পীরা কোনও দিনই তাঁদের যোগ্যতার সম্মান সে ভাবে পাননি। খুব কম মানুষই জানেন এমএফ হুসেন-এর মতো চিত্রশিল্পী, যাঁকে ভারতের পিকাসো বলে চিনতেন অনেকে, তাঁর কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ছবির পোস্টার এঁকেই।

পুরনো দিনের মানুষদের অনেকেরই মনে আছে, একজন শিল্পী পোস্টার আঁকার কাজ শুরু করলেই তাঁরা উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করতেন। সেই ক্যানভাসে কোন শিল্পীর ছবি ফুটে উঠবে। বা কোন ছবির প্রচার করা হবে সেই পোস্টারে। ফ্যাশন ডিজাইনার নিদা মেহমুদ বলছিলেন তাঁর এ রকম অভিজ্ঞতার কথা। ‘‘এই আর্ট ফর্মটা ছিল দেখার মতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, কম্পিউটার ইমেজ এসে যাওয়ায় ওদের ভবিষ্যৎ মুছে গিয়েছিল। এখন আবার তরুণ সব প্রতিভার হাত ধরে অন্ধ গলি থেকে বেরিয়ে এই সব শিল্প দিনের আলো দেখছে,’’ জানান তিনি। নিদা আরও জানান ছোটবেলার সেই সব হাতে আঁকা পোস্টার এখন খুব মিস করেন তিনি। আর হারিয়ে যাওয়া এই শিল্পের অনুপ্রেরণাতেই এক নামজাদা ফ্যাশন শো-এর কয়েক বছর আগে স্প্রিং-সামার কালেকশনটি ডিজাইন করেছেন তিনি। তাতে অনেকেই বেশ কৌতূহলী হয়ে পড়েন।

নিদা আরও জানালেন, ‘‘কুড়ি বছর হল পোস্টার আর্টিস্টদের অস্তিত্ব আর কোথাও নেই। আমার উদ্দেশ্যটাই ছিল এই শিল্পীদের আবার মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা।’’ অনেক কষ্টে তাদের শুধু খুঁজে বের করেছেন তাই নয়, তাদের কয়েকজনকে চাকরিও দিয়েছেন নিজের কাছে। পোশাক, জ্যাকেট, হ্যান্ডব্যাগ, শাড়ি, চাবির রিং, কোস্টার— ডিজাইন করছেন এই শিল্পীরা নিদার কাছে। যাঁরা ভিন্টেজ জিনিসপত্র সংগ্রহে রাখেন, যেমন ধরুন বলিউডের ছবির পোস্টার, অন্দরসজ্জার জিনিসপত্র, বা আর্ট গ্যালারির নানান আইটেম, তাঁরাও এখন এগুলোকে সংরক্ষণ করছেন। ‘‘গত বছর মুঘল-এ-আজম ছবির এ রকম দু’টো পোস্টার তো ইতিহাস তৈরি করে ফেলেছিল। একটা অকশনে শাহরুখ খান পোস্টার দু’টো কিনে নেন প্রায় সাত লক্ষ টাকায়,’’ জানালেন হিনেশ জেঠওয়ানি যাঁর সংস্থা ইন্ডিয়ান হিপি-ওই দুই পোস্টার খুঁজে বের করেছিল। তবে তার সঙ্গে এ-ও জানালেন, নব্বইয়ের শুরুর থেকেই এই ধরনের পোস্টারগুলো ইতিহাসের গর্ভে চলে গিয়েছে। ‘‘দেখুন কম্পিউটারে এত সহজে ইমেজ তৈরি করে নেওয়া যায় এখন। কাজেই প্রযোজকরা অপ্রয়োজনীয় টাকা খরচ করতে চান না। আর অভিনেতারাও কম্পিউটারে তৈরি ছবি পছন্দ করেন বেশি। কারণ ডিজিটাল ছবিগুলোকে সহজেই এয়ারব্রাশ করা যায়,’’ বলছিলেন হিনেশ।

নিদার গলায় ক্ষোভ স্পষ্ট। এই শিল্পীরা রাতারাতি কোথায় গেলেন, কেউ কিছু জানতেই চাইলেন না! ‘‘কম্পিউটারের একটা ক্লিকে এতগুলো মানুষের রুজিরুটি বন্ধ হয়ে গেল। কোনও বিকল্প কর্মসংস্থানও হল না তাদের। আমি যখন ওদের খুঁজতে যাই, ওরা কথাই বলতে চায়নি প্রথমে। আমার সৌভাগ্য আমি সেই লোকটাকে খুঁজে বের করে ফেলি যে অমিতাভ বচ্চনের ‘দিওয়ার’-এর পোস্টার এঁকেছিল। খুব বৃদ্ধ আর অসুস্থ তিনি তখন। তাঁর ছেলে একটা ছোট্ট ছাপাখানার ব্যবসা চালাচ্ছেন তখন। সবচেয়ে বড় ভাগ্যের পরিহাস হল এই প্রায়-অবলুপ্ত শিল্প নিয়ে কোনও কথা বলতেই রাজি ছিলেন না তাঁরা।’’

পরিচালক-অভিনেতা ইমরান জাহিদ ফেসবুকে একতার আঁকা ছবির পোস্টার দেখেছিলেন। তিনি তখন তাঁর নাটকের জন্য পোস্টার আঁকতে বলেন তাঁকে। ‘‘একতার আঁকা পোস্টার দেখাটা একটা কো-ইনসিডেন্স ছিল। সত্যি বলতে অন্য রকম কিছু হলে সেটা চোখ টানেই। তখন ওকে বলি আমার নাটকের পোস্টারটা এঁকে দিতে। পরিবর্তনই বেঁচে থাকার মূল কথা। এখন হাতে আঁকা পোস্টার আবার কামব্যাক করেছে নতুন করে। আর ভট্ট (মহেশ) সাব-ও নতুন প্রতিভাদের সব সময় স্বীকৃতি দেন। নতুন প্রজন্মও খুব পছন্দ করছে এই শিল্পকে,’’ জানান ইমরান।

হিনেশ আরও জানালেন এখনকার সময়েও এই হাতে আঁকা পোস্টারগুলোর সাঙ্ঘাতিক চাহিদা আছে। তবে ভিন্টেজ পোস্টারের চাহিদা তুলনায় বেশি। ‘‘হ্যান্ড পেন্টেড হিন্দি ছবির এই পোস্টারগুলোর চাহিদা প্রচুর। ক্যালিফোর্নিয়ায় গুগল অফিসের এক রেস্তোরাঁর গোটা ডিজাইনটাই আমি করেছি হাতে আঁকা এই পোস্টার দিয়ে। এমনকী বিয়েবাড়ি বা পার্টিতেও আমি ওগুলো ব্যবহার করি। কর্ণ জোহর, মন্দিরা বেদীদের পার্টিও আমি সাজিয়েছি এই সব পোস্টার দিয়ে,’’ বললেন হিনেশ।

ইন্টিরিয়র ডিজাইনার আর সংগ্রাহকেরা সব সময়ই এই পোস্টারগুলোর খোঁজ করেন। আর আমেরিকা, ইউকে-র লোকজন কেনেন ওই শৈলীটার জন্য, বলিউড বা হিন্দি ছবি নিয়ে তাঁদের সে রকম একটা ধারণা না থাকলেও। ছবির পোস্টার নিয়ে ব্যবসা করেন রঞ্জিত সিংহ। সম্প্রতি তিনি ‘ওম শান্তি ওম’ ছবির পোস্টারের অর্ডার পেয়েছেন নয়াদিল্লির ব্রিটিশ এমব্যাসি থেকে। বেশ উত্তেজিত তিনি সে ব্যাপারে। নিদা নিজেও ভারতীয় ছবির পোস্টার নিয়ে একটা গ্র্যাফিক নভেল লিখবেন খুব শিগগির। বললেন, ‘‘এই শিল্পটাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। তবে বানানো সংস্করণগুলোর প্রতি নয়। বিনোদন জগতের একজনের সঙ্গে এই শিল্পটাকে ফিরিয়ে আনা নিয়ে কথা চলছে আমার। তবে এখনই কিছু বলতে পারব না সে বিষয়ে,’’ জানান নিদা।

একতা যদিও তাঁর এই কাজের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের থেকে। ‘‘সত্যজিৎ রায়কে শুধু তাঁর ছবির জন্য নয়, তাঁর শিল্প, তাঁর আঁকা, তাঁর ডিজাইনের জন্য আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। ওঁর থেকেই হাতে পোস্টার আঁকার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আমি স্বপ্ন দেখতাম এই শিল্পটাকে বাঁচিয়ে তোলার। সেটা কিছুটা হলেও করতে পেরেছি। আমি খুব খুশি,’’ গর্বিত শোনায় একতাকে।

সিনেমা হলের বাইরের দেওয়াল থেকে হাতে আঁকা ছবির পোস্টার এখন জায়গা করে নিয়েছে বিলাসবহুল বাসস্থান, রেস্তোরাঁ, কফিশপের অন্দরসজ্জায়। এমনকী জাঁকজমক পূর্ণ পার্টিতেও আজকাল হাতে আঁকা পোস্টারের রমরমা। ‘‘কে বলতে পারে নাটকে প্রোমোশনাল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পর এটা কোনও মার্কেটিং গুরুর নজরে পড়বে কি না? দেখা যাবে কিছু দিন পর আরেকটা ছবি প্রোমোট করতে হাতে আঁকা পোস্টারেরই প্রয়োজন হচ্ছে!’’ বললেন জাহিদ।

হাতে আঁকা পোস্টারের বাজার আবার ফিরল বলে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE