‘‘এমন একটা দিন গিয়েছে যখন শ্যুটিংয়ের মাঝে ভ্যানিটি ভ্যানে বসে হাউহাউ করে কেঁদেছি।’’
কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে দীপিকা পাড়ুকোন এই কথাগুলো বলে চমকে দিয়েছিলেন অনেককে।
তারকাদের অসুখ-বিষুখ নিয়ে খুল্লামখুল্লা কথা বলা শুরু হয়েছে ঠিকই এ দেশে। অমিতাভ বচ্চন যে ২০০০ সালে টিউবারকিউলোসিসে ভুগেছেন সে নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছেন। সলমন খান মুখ খুলেছেন তাঁর ট্রাইজেমিনাল নিউরোলজিয়া নিয়ে। যে কারণে একটা সময়ে তাঁর মুখে, চোয়ালে আর গালে অস্বাভাবিক ব্যথা হত। হৃতিক রোশন কথা বলেছেন তাঁর ক্রনিক সাবডিউরাল হেমাটোমা নিয়ে। সঞ্জয় দত্ত তাঁর ড্রাগের নেশা নিয়ে কথা বলেছিলেন। এ ছাড়া ক্যান্সার যুদ্ধ নিয়ে তো অনেকেই সরব হয়েছেন।
কিন্তু মনোরোগ নিয়ে কোনও তারকাই কি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সাহস দেখাননি।
তারকাদের ভয় একটাই। অমন কথা বললে যদি তাঁকে পাগল সাব্যস্ত করে দেওয়া হয়? দুঃখবিলাসী বলে যদি ভুল করে ফেলে দর্শক? আর তার ফলস্বরূপ যদি ইন্ডাস্ট্রি থেকে ব্রাত্য হয়ে যান তিনি?
তার থেকে চুপ করে সহ্য করে যাওয়াই ভাল। কেউ কেউ গোপনে ডাক্তারের সাহায্য নিয়েছেন বইকী। কিন্তু সে কথা নিয়ে আমজনতার সামনে মুখ খোলেননি। তবু ভয় পাননি দীপিকা। পাশে ছিলেন তাঁর মা উজ্জ্বলা পাড়ুকোন। সঙ্গে তাঁর কাউন্সিলর এবং মনোবিদ। সবার সামনে বললেন কী ভাবে এক একদিন ঘুম থেকে উঠে দিশেহারা লাগত তাঁর, মনে হত কোন দিকে এগোবেন, তাঁর কোনও পথ নেই। আর তার পর শুরু হতো হঠাৎ হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়া!
কিছু বছর আগে মনীষা কৈরালা তাঁর ফেসবুক পেজে নিজের অবসাদ নিয়ে লিখেছিলেন। পরবর্তী কালে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে সে কথা স্বীকার করে বলেছিলেন যে, নানা সময়ে মনে হয়েছে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন। কান্নাকাটি করেছেন। তবে বাইরের পৃথিবীতে কিছুই জানতে দেননি তাঁর অবসাদের কথা। অভিনয় করতে গিয়ে সব কিছু ঢাকা পড়ে গিয়েছে। অবসাদ নিয়ে মনীষা যতটা না কথা বলেছেন তার থেকে ঢের গুণ বেশি সোচ্চার হয়েছেন দীপিকা। আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও অনেকেই বুঝতেন না যে, যে কোনও সিরিয়াস অসুখের থেকে অবসাদ আলাদা নয়। বুঝতেন না যে ভিলেনের ঘুষিতে নায়কের চোয়াল ফেটে গেলে যদি লজ্জা পাওয়ার কিছু না থাকে তা হলে ক্যামেরার বাইরের সেই তারকার মানসিক রক্তক্ষরণ নিয়েও চুপ চুপ করার কিছু নেই।
আজ কুণ্ঠাবোধটা কমেছে। তবে তাই বলে কি দীপিকার দেখানো রাস্তায় এখন অন্যরাও হাঁটতে চাইবেন?
দীপিকাকে স্যালুট কিন্তু...
দীপিকাকে স্যালুট করে পরিচালক মহেশ ভট্ট মনে করেন সে রকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ‘‘প্রায় ২৬ বছর আগে আমি প্রকাশ্যে মদ নিয়ে নিজের আসক্তির কথা বলেছিলাম। কিন্তু তাই বলে কি ইন্ডাস্ট্রির অন্য অ্যালকোহলিকরাও সে সব নিয়ে কথা বলেন? আজ আবারও মনে পড়ছে পরভিন ববির সেই সব দিনগুলোর কথা। কেউ এ রোগ নিয়ে তখন কথাই বলত না। মিডিয়াও এ বিষয়ে একদম অশিক্ষিত ছিল,’’ জানান মহেশ।
তিনি সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন দীপিকার অনুপ্রেরণায় অন্যান্য তারকারা তাঁদের মানসিক অবসাদ নিয়ে কথা বলবেন। ‘‘একজন জনপ্রিয় নায়ককে বলেছিলাম তার ডাক্তার দেখানো উচিত। কমেডি রোলে তাঁর জবাব নেই। শুনে ও শুধু হেসেছিল। আজ পর্যন্ত ডাক্তার দেখায়নি। আরও একজন জনপ্রিয় অভিনেতার কথা জানি যে আমার কানে কানে এসে তার অবসাদ নিয়ে কথা বলে। ফিল্মে অভিনয় করছে। নাটক করছে। তার সঙ্গে ডাক্তারের কাছেও যায়। ওষুধও খায়। কিন্তু কোনও দিন প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলে না,’’ স্পষ্ট জানিয়ে দেন মহেশ।
মেক আপ ভ্যানে কান্না
বাবা মারা যাওয়ার পর বিষাদ গ্রাস করেছিল ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে। দীপিকার মতো না হলেও কিছু দিন বিষাদে ভুগেছিলেন তিনিও। ‘‘সবাই জানে আমি কাজ পাগল মানুষ। কিন্তু সেই আমি কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলেছিলাম। মা-কে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম আমেরিকাতে। বেশ কিছু দিনের গ্যাপ। তার পর যখন শ্যুটিং করতে আসি, মাঝে মধ্যেই চোখ বেয়ে টসটস করে জল পড়ত। সে সময় মধুর ভাণ্ডারকরের ‘দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি’র শ্যুটিং করছিলাম। হাসির ছবি। শট দিয়েই আমি মেক আপ ভ্যানে গিয়ে কাঁদতাম। আমার কাকু একজন সায়েকিয়াট্রিস্ট। ওঁর সঙ্গে মাঝে মধ্যেই আলোচনা করতাম। আলাদা করে আমাকে কোনও দিন ডাক্তারের সাহায্য নিতে হয়নি।’’ ঋতুপর্ণা স্বীকার করছেন যে টলিউডেও তিনি আরও অনেক রকম ঘটনা দেখেছেন। বলছেন, ‘‘অনেক বছর আগে আমার এক সহ-অভিনেত্রীকে দেখেছিলাম অবসাদে ভুগতে। তখন ওর বিয়ে ভাঙছে। সেই সঙ্গে একটা ঝোড়ো অ্যাফেয়ার চলছিল অন্য এক অভিনেতার সঙ্গে। এমনও সময় গিয়েছে যখন ও আত্মহত্যার কথা ভাবত। ’’
অবসাদ ও সৃজনশীলতা
সৃজনশীলতার সঙ্গে অবসাদের যোগাযোগ নিয়ে দ্বিমত রয়ে গিয়েছে। আমেরিকান লেখক উইলিয়াম স্টায়রনের ‘ডার্কনেস ভিসিবল: আ মেময়ের অব ম্যাডনেস’ বইয়ে স্টায়রন শুধু নিজের অবসাদ নয়, অ্যালবার্ট কামু থেকে অ্যাব্রাহাম লিঙ্কনের অবসাদের প্রসঙ্গও তুলে এনেছেন। হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে কে রোলিংয়ের ডিভোর্সের পরে চূড়ান্ত মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেন। চাকরি বাকরি নিয়ে শিশুকন্যা জেসিকাকে মানুষ করার ভার তাঁর নিজের কাঁধে। সে সময় আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে যান। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। যে ডাক্তার তাঁকে সবসময় দেখতেন তিনি ছিলেন ছুটিতে। তাঁর পরিবর্তে যিনি ছিলেন, তিনি আবার মানসিক অবসাদ ব্যাপারটাই বুঝতে পারেননি। হতবাক রোলিংকে শুনতে হয়েছিল যে, মন কেমন করলে যেন হাসপাতালে এসে নার্সের সঙ্গে দেখা করেন! দু’সপ্তাহ পরে ভাগ্যবশত রোলিংয়ের পুরনো ডাক্তার ফিরে আসেন। সব নথিপত্র দেখে তিনি রোলিংকে ‘কগনিটিভ বিহেবিহেরাল থেরাপি’ করার কথা বলেন। ন’মাস ধরে সেই থেরাপি করে রোলিং এই কঠিন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসেন। অবসাদে ভোগার সময় জে কে রাউলিং লিখতে শুরু করেছিলেন তাঁর ‘হ্যারি পটার’-এর গল্পগুলো।
মহেশ নিজে যদিও কোনও দিন অবসাদে ভোগেননি, তবে স্বীকার করছেন নিঃসঙ্গতার দীর্ঘ সব মুহূর্তের কথা এবং কী ভাবে সেই দুঃখের প্রকাশ ঘটিয়েছেন সৃজনশীলতার মাধ্যমে। ‘‘যে কোনও ক্রিয়েটিভ মানুষের কাছে অবসাদকে ক্রিয়েটিভিটির মধ্যে দিয়ে চ্যানেলাইজ করার ক্ষমতা একটা বিশাল গুণ,’’ বলে দাবি করেন মহেশ।
কন্যা আলিয়া ভট্টকে নিয়ে ইন্টারনেটের জোকস দেখে কি নায়িকার ডিপ্রেশন হয়েছে? উত্তরে মহেশ জানান, ‘‘না হয়নি, কারণ ও জানে যে ইমেজটা তৈরি করা হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়। যদি হত, তা হলে ওই রকম একটা অডিয়ো ভিশ্যুয়াল তৈরি করতে পারত না যেখানে ও নিজের ওপরেই হেসেছে। আলিয়া আমায় বলেছিল, ‘‘আমি তো তোমারই মেয়ে। এই বাড়িতে থেকে যদি এটা না করতে পারি, তা হলে আর কোথায় করব!’’
সেলেব্রিটি বনাম আমজনতা
সাধারণ মানুষের প্রিভেসি নিয়ে সমস্যা হয় না। কিন্তু সেলেব্রিটিদের সমস্যা আলাদা। বিদেশের জনপ্রিয় ক্যুইজ শো হোস্ট স্টিফেন ফ্রাই স্বীকারোক্তিতে বলেছিলেন ‘QI’ শো-টা করতে গিয়ে কান এঁটো করা হাসি মুখে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মৃত্যুচিন্তায় জর্জরিত। ‘‘সমস্যা হয় ঠিকই। কিন্তু কাজের ব্যস্ততার সুবিধা হলা বিষাদ নিয়ে ভাববার সময়টা কম পাই,’’ বলছেন ঋতুপর্ণা।
বলতে দ্বিধা কেন
সাফল্যের পরেও রাউলিং তাঁর বিষাদের কথা গোপন করেননি। বলেছেন, ‘‘লজ্জা পাওয়ার আছেটা কী? জীবনের একটা কঠিন সময় দিয়ে গিয়েছিলাম, আর আমি গর্বিত যে ওটার থেকে বেরোতে পেরেছি।’’ বহু বছর ধরেই অনেক সেলেব্রিটি রুগিদের দেখছেন ডা. জয়রঞ্জন রাম। তাঁর মতে তারকাদের এই দ্বিধাটা থাকা অস্বাভাবিক নয়। ‘‘দীপিকা যে বয়সে এ রকম একটা সাহসী কাজ করেছে, সেটার জন্য ওকে কুর্নিশ জানাচ্ছি। একমাত্র সেরেনা উইলিয়ামসকে দেখেছিলাম অবসাদ নিয়ে এই বয়সে দাঁড়িয়ে স্বীকারোক্তি করেছে। আসলে যারা বলে না, তাদেরও আমি দোষ দিই না। এই ফেজটা খুব কষ্টের। তাঁরা সেরে উঠলে আর ওই সময়টা নিয়ে চর্চা করতে চান না,’’ বলছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মনোবিদ বলছেন, ‘‘এক তারকা ডিপ্রেশনের জন্য কাউন্সেলিং করতেন। সেরে ওঠার পরে তাঁকেই দেখেছি অবসাদ নিয়ে সাক্ষাৎকারে ঘুমের সমস্যা বলেই এড়িয়ে যাচ্ছেন বিষয়টাকে।’’
অটোগ্রাফ প্লিজ
এই সময় হীনমন্যতায় ছাপটা বেশ গাড় ভাবেই চেপে ধরে। ‘‘মানুষ ভাবে অন্য সব অর্গানগুলো তাঁদের কন্ট্রোলে না থাকলেও মনটা সব সময়ই তাঁদের কন্ট্রোলে থাকে। অবসাদ হলে কেমিক্যাল ইমব্যালান্সের জন্য যে সেই কন্ট্রোলটা চলে যায়। সেটা তাঁরা মেনে নিতে পারেন না। আজও অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারানোকে রসিকতার বিষয় বা গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেটা অন্য রোগের ক্ষেত্রে হয় না। তাই অনেকেই এ কথা বলতে চান না। চেম্বারে রাত দশটার পরে গোপনে আসতে চান। কেউ হয়তো স্বাভাবিক সময়ে দেখাতে এসেছেন। কিন্তু তারকাকে দেখে অটোগ্রাফ চেয়ে বসেছেন অন্যরা!’’ বলছেন ডা. রাম। মীর অবশ্য এ রকম কিছুই করেননি। ‘‘রিমাদি বলেছিলেন যে চেম্বারে এলে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমি ওর চেম্বারে অন্যান্য পেশেন্টের মতোই যেতাম,’’ বলছেন মীর।
কে কখন কী বলবে সেটা অবশ্য নির্ভর করে তাঁর জীবন দর্শনের ওপর। মীরের ভাষায়, ‘‘চার্লি চ্যাপলিন, রজনীকান্তের মতো কেউ কেউ চায় একটা ইমেজ নিয়ে বাঁচতে। আর কেউ কেউ এটা বলতে দ্বিধা করে না যে সেলিব্রিটিরাও রক্তক্ষরণ হয়।’’ দীপিকার পরে মুখ খুললেন মীর। সময় বলে দেবে মীরকে দেখে অন্যরাও এ নিয়ে কথা বলতে এগিয়ে আসবেন কিনা।
কখন ডাক্তার দেখাবেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy