Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ধোনি-সঙ্কট

অস্ট্রেলিয়ায় টি২০ সিরিজ জিতলেও ধর্মসঙ্কটে পড়েছেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। অধিনায়কত্ব রাখবেন? নাকি ছেড়ে দেবেন বিরাট কোহলিকে? লিখছেন জিএস বিবেক বিশ্ব ক্রিকেটের সেরাদের ধর্মশালায় অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অক্টোবরের থেকে ভাল সময় আর কীই বা হতে পারে! ঠান্ডাও তেমন পড়ে না সে সময়। ধৌলধর রেঞ্জ তুষারে ঢেকে যেতে তখনও তো মাস দুয়েক দেরি।

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:০০
Share: Save:

বিশ্ব ক্রিকেটের সেরাদের ধর্মশালায় অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অক্টোবরের থেকে ভাল সময় আর কীই বা হতে পারে!

ঠান্ডাও তেমন পড়ে না সে সময়। ধৌলধর রেঞ্জ তুষারে ঢেকে যেতে তখনও তো মাস দুয়েক দেরি।

তবু এমন মনোরম আবহাওয়াতেও গত অক্টোবরে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি কিন্তু শিরদাঁড়াতে অনুভব করছিলেন ঠান্ডা স্রোত।

হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের স্টেডিয়ামের আবহাওয়া ধোনির কাছে অপরিচিত নয়। নীল আর হলুদ জার্সিতে অনেক ম্যাচ খেলেছেন এখানে। কিন্তু এ বারের ব্যাপারটা যেন একটু অন্যরকম। শুধু বাইরের আবহাওয়াই নয়। শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজের পর ড্রেসিং রুমের আবহাওয়াটাও যেন হঠাৎ করে বদলে গিয়েছে।

টিমে পছন্দের প্লেয়ার বা ক্যাবিনেটে ট্রফির ভিড় — ধোনি এত দিন যা চেয়েছেন, তাই-ই পেয়েছেন। ক্রিকেটে একটা কথা আছে, ‘টিম ভাল হলেই ক্যাপ্টেন ভাল’। ধোনি টিম তৈরি করেছেন নিজের হাতে। হয়তো কোচও। আর সব মিলিয়ে সাফল্যের এমন সুন্দর চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন যে, শেষ দশকের সব থেকে প্রভাবশালী ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের নাম মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। আর ইন্ডিয়া টিম একদিন যে হাইওয়ে দিয়ে চলে এসেছে, তার নাম হয়ে গেছে ‘মাহি ওয়ে’।

তবে এখন সে রাস্তায় কিন্তু ট্র্যাফিক জ্যাম।

ধোনির হাতে খুব বেশি সময় ছিল না। ছিল না খুব বেশি চয়েসও। ২০১৫য় হারের মিছিল ধোনির জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল। সেই সঙ্গে বিরাট কোহলির নেতৃত্বে টেস্টে টিম ইন্ডিয়ার সাফল্য ধোনির ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছিল। ধোনি কম চেষ্টা করেননি। বোর্ডরুমের প্রথাগত ব্যবস্থার বদল করেছিলেন। কিন্তু সে ঝুঁকি উল্টে চাপ বাড়িয়েছিল তাঁর উপরই। আর সে সময়ই হয়তো ধোনি ঠিক করেন টিম চালানোর স্বভাবসিদ্ধ ‘ধোনি স্টাইল’‌য়ের সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করার সময় এসে গেছে।

এমনটা কিন্তু আগে হয়নি। কিন্তু এ বার পরিস্থিতি পুরোটাই ধোনির বিপক্ষে ছিল। নির্বাচকদের সঙ্গে যেন এক অদৃশ্য লেনদেন হয়েছিল এমএসডি-র। তাঁরা ধোনিকে ধোনির পছন্দের টিম আর দিলেন না। অন্য দিকে টি২০ ওয়ার্ল্ড কাপ অবধি ক্যাপ্টেনসির দায়িত্ব দেওয়া হল সেই ধোনিকেই। না বললেও, নির্বাচকরা যা বার্তা দিলেন, তা হল — এই নিয়েই ধোনিকে জেতাতে হবে টিম ইন্ডিয়াকে।

এটা করে বোর্ড প্রথমেই মিডিয়াতে ‘ধোনি থাকছে, না ধোনি যাচ্ছে না’ এই আলোচনাটা বন্ধ করে দিল। আর ধোনিকেও সময় ও স্পেস দেওয়া হল ‘ফিনিশার’য়ের তকমাটা আবার ফিরে পাওয়ার। তত দিনে টিম ইন্ডিয়ার ড্রেসিং রুমে এসে গিয়েছেন যুবরাজ, এসেছেন হরভজন, নেহরাও। এই তিনজন এসে পড়াতে ক্যাপ্টেন ধোনির ওপর প্রেশার আরও একটু যে বেড়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। এবং সেই প্রেশারটা কিন্তু ধোনি অস্ট্রেলিয়াতে ভালই হ্যান্ডেল করলেন।

অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে ধোনির এই নতুন পাওয়া সাফল্য শুধু ক্যাপ্টেন হিসাবে রেকর্ডের খাতায় নতুন পালক যোগ করল না (অস্ট্রেলিয়াতে দু’টো সিরিজ জয়), তাঁর কেরিয়ারেরও এক নতুন অধ্যায় শুরু হল এই সিরিজ থেকে।

এই প্রথম ধোনিকে ‘ব্রিফ’ করা হল টিম কী ভাবে চালানো হবে তা নিয়ে।এবং সেখানেই শুরু হল ধোনির ক্রিকেট জীবনের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। এমনিতে ধোনিকে সবাই বলে একগুঁয়ে বা রিজিড, কিন্তু অনেকেই জানেন না পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে ধোনির আজও জুড়ি মেলা ভার। এই নতুন ধোনি কিন্তু আস্তে আস্তে নিজেকে ভেঙে ফেললেন। পাল্টে ফেললেন। আজকে টিমের ইয়ং স্টার থেকে শুরু করে অভিজ্ঞ সিনিয়র— সবার পরামর্শ শুনছেন।

কারণ পাখির চোখ তো টি২০ বিশ্বকাপের ট্রফি। সন্দীপ পাটিল, রবি শাস্ত্রী তো আছেনই, টিমে আছেন বিরাট কোহলিও — তবু সবাই জানে বিশ্বকাপ পেলে, জয়ের কারিগর হিসেবে নাম হবে ধোনিরই।

ধোনি এখন ক্যাপ্টেন হিসাবে অনেক বেশি ডেমোক্র্যাটিক।

পরামর্শ শোনেন সবার। পুরনো একরোখা একনায়কতন্ত্রের অভ্যেসটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। কারণ তিনি স্পষ্ট বুঝেছেন, ওই স্টাইল অব ক্যাপ্টেনসি এই সময়ে অচল।

তার একমাত্র কারণ টিম ইন্ডিয়ায় লম্বা হওয়া বিরাট কোহলির ছায়া। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টি২০ আর ওয়ানডে সিরিজের পর ধোনির আসন সত্যিই টলোমলো হয়ে উঠেছিল। ভাগ্যের এমন ফের, বিরাটকে ওই সিরিজে ক্যাপ্টেনসি করার সুযোগ, সেই স্পেস নিজে হাতে তৈরি করে দিয়েছিলেন ধোনি স্বয়ং।

কিন্তু রানের পাহাড়ে বসা বিরাটের শুধু ওইটুকু স্পেসে তর সইছিল না। তাঁর দরকার তখন আরও বেশি জায়গা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল ড্রেসিং রুমের নতুন ‘গ্যাং’। বিরাটের ছোটবেলা থেকে পরিচিত শিখর, রোহিত আর ইশান্ত তো ছিলেনই। সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন রাহানে, অমিত মিশ্র, উমেশ যাদব, বরুণ এরন — সবাই বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁরা ধোনির থেকে বিরাটের সঙ্গে বেশি স্বচ্ছন্দ। নিজের একদা অনূর্ধ্ব -উনিশ ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ক্রিকেট মাঠে ম্যাজিক তৈরিতে বেশি সময় নেননি রবীন্দ্র জাডেজাও। অশ্বিন ছিলেন এই নতুন ‘গ্যাং’‌য়ের লিডার। বিরাটের আমলে পাওয়া এই স্বাধীনতা অশ্বিনও উপভোগ করছিলেন ভাল ভাবেই।

সমস্যা আরও বাড়ছিল কারণ ধোনির অনেক মিথকেই ভেঙে দিয়েছিল বিরাটের স্টাইল। এমনকী এটা লিখতেও হাত কাঁপবে না যে, ধোনির ‘অরা’কেও প্রায় পাংচার করে দিয়েছিলেন কোহলি।

বাইরে থেকে দেখলে হয়তো মনে হবে বিরাট শুধু ইন্ডিয়ার টেস্ট টিমের ক্যাপ্টেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দিল্লির ছেলেটা কিন্তু ধোনির অধিনায়কত্বের মেথডটাই পাল্টে দিয়েছেন। বিরাট টিম মেম্বারদের সঙ্গে অনেক বেশি কথা বলেন, এমনকী বোলারদের জিজ্ঞাসা করেন তাঁদের প্ল্যান কী! এটাই বিরাটের স্টাইল, যা ধোনির স্টাইল থেকে ছিল একেবারেই আলাদা।

একসময় সত্যি মনে হচ্ছিল এই টিম ইন্ডিয়ায় ধোনি যেন অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশকারী। রবি শাস্ত্রীর প্রতিনিয়ত ‘কম্যান্ড’ ধীরে ধীরে ম্লান করে দিচ্ছিল ধোনির পুরনোপ্রতাপকেও। জীবনটা হঠাৎ করে আর আগের মতো রইল না। গত কয়েক মাসে বিসিসিআই বোর্ডরুমেরও যা অবস্থা, তাতে সংকটের সময় শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যাও গিয়েছিল কমে ধোনির।

ঘনিষ্ঠ মহল বলছিল, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অনেক দিনই ধোনির হাতছাড়া। আর তাই নিজেকে আস্তে আস্তে এই সব থেকে সরিয়েও নিচ্ছিলেন তিনি। ধোনির লক্ষ্য: যা আছে তা দিয়ে কী করে ম্যাচ জেতা যায়। বেশি দূরের দিকে না তাকিয়ে শর্ট টার্ম গোল-ই এখন রাঁচির ছেলের ফোকাস। নতুন প্লেয়ার গ্রুম করে ম্যাচ জেতানোর মতো কথা মিডিয়াকে বলার জন্য চলতে পারে, কাজের ক্ষেত্রে তা একেবারেই ধোপে টিকবে না। ধোনিও এই সাফল্যে খুশি। আর যারা ভাবছিল টি২০ বিশ্বকাপের পর রিটায়ার করবেন ধোনি, এখন তাদের মুখে ছাই দিয়ে বেশ মজাই পাচ্ছেন মাহি।

কিন্তু ধোনিকে যাঁরা ভালভাবে চেনেন তাঁরা জানেন ধোনি সম্বন্ধে শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। ধোনি চুটিয়ে উপভোগ করছেন ক্রিকেট। কিন্তু কে বলতে পারে, একদিন হয়তো নিজে থেকেই অধিনায়কত্বের টুপিটা দিয়ে দেবেন বিরাটকে। সাধারণ একজন প্লেয়ার হিসেবে থেকে যাবেন ড্রেসিংরুমে।

কী বললেন? অসম্ভব?

আরে, ধোনি তো পুরো কেরিয়ার জুড়ে আমাদের সঙ্গে মজাই করে গেলেন। তাই নয় কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mahendra singh dhoni virat kohli MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE